হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশের অবস্থা
2025.03.27

প্রায় এক দশক পর ১ মার্চ ২০২৫ বাংলাদেশে এলাম। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী দেখে তাৎক্ষণিকভাবে আমি বাংলাদেশ সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
নগরীতে নতুন মেট্রো রেল, এলিভেটেড সড়ক হয়েছে– এসব কথা দূর থেকে অনেক শুনেছি। এই বলয়ের বাইরে দেশটিতে নতুন কী দেখতে পাব সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম না।
দুই সপ্তাহ যাবত একের পর এক সভা, ইফতার, গণমাধ্যমের মুখোমুখি হওয়া এবং ঢাকার কুখ্যাত যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে আমি দেশটির অন্তর্বর্তী নেতৃত্বের সামনে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে আরো সূক্ষ্ম ধারণা পেয়েছি।
যেমনটি বলা হয়, “স্বচক্ষে দেখলেই সব বুঝা যায়।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উৎখাতকারী জুলাইয়ের আন্দোলনের একজন প্রথম সারির ছাত্রনেতা আফসোসের সুরে বলছিলেন, বিপ্লবের শুরু দিকে ঢাকায় এলে আরও ভালো বুঝতেন।
গণঅভ্যুত্থানের সাত মাস পর সেই ছাত্র ও তাঁর সহযোদ্ধারা স্পষ্টত বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন— এক নতুন বাস্তবতা— যেখানে রাজপথের আন্দোলনের পরিবর্তে সহযোগিতা ও আপোষমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্রমবর্ধমানভাবে পরিবর্তন আসবে।

যারা একসময় "বাংলাদেশ ২.০" নিয়ে ব্যাপক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁরা এখন বোঝেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে সংস্কার কার্যক্রম চলছে, তা খুবই সীমিত ফলাফল দিতে পারে।
অন্যদিকে ছাত্রদের হতাশ মনে হয়নি। তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি, থিংক-ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা এবং অন্যান্য সংস্কার কর্মীদের সাথে সংযোগ গড়ে তুলতে শুরু করেছে।
তবে বাংলাদেশে অনেকেই শঙ্কিত, শেখ হাসিনার সরকার পতনের সময় যে আবেগ ও উচ্ছ্বাস ছাত্ররা দেখিয়েছে, তা আবার দেখা দিতে পারে এবং আরও অন্ধকার মোড় নিতে পারে। যার ফলে অসহিষ্ণুতা দেখা দিতে পারে এবং জাতীয় পুনর্মিলন ব্যাহত হতে পারে।
অনেকে মনে করেন, সবচেয়ে খারাপ হবে যদি পরবর্তী সরকার ছাত্রদের অবমূল্যায়ন বা বিরোধিতা করে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত – বাংলাদেশের জেনারেশন জেড (Gen-Z) হারিয়ে যাবে না, বরং দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে ভূমিকা রাখবে।

অনেকের কাছে এটিও স্পষ্ট যে, হাসিনার ধারাবাহিক মেয়াদে বিরোধী দলে থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সম্ভবত পরবর্তী সরকার গঠন করবে।
বিএনপি জনসমক্ষে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এবং ইউনূসের নেতৃত্বাধীন "জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে" অংশ নিচ্ছে।
তবে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে ব্যাপক সংশয় রয়েছে।
বর্ষীয়ান নেত্রী খালেদা জিয়া অসুস্থতার কারণে হয়তো নিজে দায়িত্ব নিতে পারবেন না। দলটি নির্বাচনে জয়ী হলে তারেককে প্রধানমন্ত্রী করা হবে ধারণা করা হয়। ১৭ বছর ধরে দেশের বাইরে তারেকের একটি সংস্কার কর্মসূচি রয়েছে, তবে তিনি প্রতিশ্রুতি রাখবেন কিনা তা নিয়ে মানুষ সন্দিহান। যাকে তারা আসলে চেনে না, তাঁকে বিশ্বাস করা অনেকের জন্য কঠিন হতে পারে।

এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতা তার সবচেয়ে কট্টর সমর্থকরাও স্বীকার করছেন– বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসনের সংস্কারে ব্যর্থতা।
হাসিনার আমলে প্রশাসন ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ে চলে গিয়েছিল, ফলে এখন নতুন নেতৃত্ব একে ঢেলে সাজাতে হিমশিম খাচ্ছে।
ইউনূসের উপদেষ্টা পরিষদের বেশিরভাগের অভিজ্ঞতার ঘাটতির সাথে সাথে সিনিয়র পদমর্যাদার অনেক কর্মকর্তাকে বহিষ্কার বা বরখাস্ত করার কারণে এই কাজটি জটিল হয়ে পড়ে।
পুলিশ ও প্রশাসনের দুর্বলতা মোকাবেলায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সতর্ক থাকতে হয়েছে, যাতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের অযথা পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে মনে না হয়।
কিন্তু জনজীবনের দৈনন্দিন উদ্বেগ মোকাবেলা করতে করতেই যদি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়, তবে এই মেয়াদের সমগ্র অবদান কালিমা লিপ্ত হবে।
শেখ হাসিনার পতন তো মূলত তাঁর সরকারের পরপর তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের ফলশ্রুতিতেই হয়েছিল।

গণতান্ত্রিক সংস্কার, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং আগামী সরকার যেন এই সাফল্যকে ধরে রাখতে পারে, এ বিষয়ে ইউনূস মনোযোগী।
তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হবে কি না।
আওয়ামী লীগের নেতারা এখনো তাঁদের অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য কোনো অনুশোচনা প্রকাশ করেননি এবং তাঁরা অন্তর্বর্তী সরকারকে দুর্বল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জনগণের প্রধান উদ্বেগ হলো, সরকার কি নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে? বিপর্যস্ত আইনশৃঙ্খলা এবং পুলিশ ও প্রশাসন দিয়ে নির্বাচন ব্যাহত করার সম্ভাব্য প্রচেষ্টা মোকাবেলা করা সম্ভব কিনা?
বেশিরভাগই মনে করেন নির্বাচনী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনীকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
স্বীকার করছি, হাসিনা পালানোর পর প্রথম দিকে আমি কিছুটা অযৌক্তিক উচ্ছ্বাসে ছিলাম। বিশ্বাস করেছিলাম, ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সম্ভব হবে। তবে বাংলাদেশ ছাড়ার সময় আমার উপলব্ধি – পরিবর্তন হবে সীমিত পরিসরে।
তবে আমি আশাবাদী– শেখ হাসিনার শাসনামলের মূল্যবান শিক্ষা বাংলাদেশ ভুলবে না।
জন ড্যানিলোভিচ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র কর্মকর্তা, যিনি দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। কূটনৈতিক কর্মজীবনে তিনি ঢাকায় তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাসে উপপ্রধান হিসেবেও কাজ করেছেন। এই লেখার মতামত তাঁর নিজস্ব এবং তা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বা বেনারনিউজের অবস্থানকে প্রতিফলিত করে না।