শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে চাকরি কোটার চেয়েও বড়ো কিছু

মন্তব্য প্রতিবেদন: আলী রীয়াজ
2024.07.17
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে চাকরি কোটার চেয়েও বড়ো কিছু আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিহতদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠানের পর পুলিশ তাঁদের সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার সময় একজন পুলিশ সদস্য আন্দোলনকারীদের দিকে অস্ত্র তাক করে আছেন। ১৭ জুলাই ২০২৪।
[বেনারনিউজ]

সরকারি চাকরিতে সংরক্ষিত কোটা কমানোর দাবিতে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক বিক্ষোভে উত্তাল বাংলাদেশ। দেশব্যাপী আন্দোলনে গত দুই দিনে অন্তত ছয়জন প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন প্রায় এক হাজার মানুষ।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের নির্বিচার প্রাণঘাতী বল প্রয়োগের ঘটনা ঘটেছে।

পরিস্থিতি এতটাই মারাত্মক হয়ে উঠেছে যে, সরকারকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা, ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেয়া এবং অস্থিরতা দমন করতে রাজধানীসহ বড়ো বড়ো শহরগুলোতে বিজিবি মোতায়েন করতে হয়েছে।

গত দুই সপ্তার তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের পর গত দুদিনে ঘটনাপ্রবাহ আকস্মিক, নাটকীয় এবং ভয়াবহ মোড় নিয়ে কেন ছাত্র আন্দোলন দ্রুত বিস্তার লাভ করল এবং সরকারের আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়ার পেছনের কারণ কী এই প্রশ্নগুলো ওঠে।

বাংলাদেশে চাকরিতে কোটা পদ্ধতি কীভাবে শুরু হয়েছিল, তার বৃদ্ধি এবং সেইসাথে গত ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই প্রথম সরাসরি প্রতিবাদটি আসলে কী, সে বিষয়ে আলোকপাত করা সহজ হয়।

আপাতদৃষ্টে এই আন্দোলন সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে, কিন্তু শিক্ষার্থীরা যে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন তার মধ্যে আছে চাকরির সুযোগের অভাব, ক্ষমতাসীন দল ও তার ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের অবাধ গুণ্ডামি এবং রাজনীতিকভাবে অধিকার বঞ্চিত হবার বিরুদ্ধে ক্ষোভ।

বাংলাদেশে চাকরি কোটা

বাংলাদেশে ৫৬ শতাংশ সরকারি চাকরি বিভিন্ন কোটার মানুষের জন্য সংরক্ষিত। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার ও বংশধরদের জন্য ৩০ শতাংশ চাকরি বরাদ্দ রাখা আছে। ২০১১ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্মের বংশধরদের এই কোটায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

চাকরির কোটার ১০ শতাংশ নারীদের জন্য, ১০ শতাংশ অনুন্নত জেলার লোকদের জন্য, ৫ শতাংশ আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে।

কোটা পদ্ধতি সংস্কারের আন্দোলন প্রথম গতি পায় ২০১৮ সালের প্রথম দিকে। প্রতিবাদকারীরা বলেছিলেন কোটা ব্যবস্থা বৈষম্যমূলক এবং অনেকেই অভিযোগ করেন যে কোটায় শুধুমাত্র তারাই উপকৃত হয় যারা শেখ হাসিনা এবং তাঁর দলকে সমর্থন করে। সেই সময় সরকার প্রতিবাদকারীদের ওপর ভয়ভীতি, হয়রানি, গ্রেপ্তার ও বল প্রয়োগ শুরু করে। ক্ষমতাসীন দলের দোসররা বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভে হামলা চালায়।

সে বছরের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি বিলুপ্ত করেন।

তবে ২০২১ সালে সাত জন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেন। ২০২৪ এর ৫ জুন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ঐ মামলার রায়ে কোটা পদ্ধতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে এবং সরকারি সার্কুলার বাতিল ও অকার্যকর ঘোষণা করে।

আদালতের আদেশে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয় এবং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু করে ১ জুলাই থেকে। সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের আদেশ চার সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেছে এবং যুক্তি শুনতে রাজি হয়েছে। তবে তাতে বিক্ষোভকারীরা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। কারণ তাঁরা মনে করছে কোটা ব্যবস্থাকে কণ্টকমুক্তভাবে বহাল রাখার জন্যই নির্বাহী বিভাগের কাজটি আদালতের ঘাড়ে দেয়া হয়েছে। নির্বাহী বিভাগের ইচ্ছাই আদালতের মাধ্যমে আসবে।

BD-b-pic.jpg
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবারের সংঘাতে নিহতদের স্মরণে গায়েবানা জানাজা শেষে কফিন মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির দিকে যেতে চাইলে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে। ৭ জুলাই ২০২৪। [বেনারনিউজ]

যেভাবে সহিংসতা শুরু

গত ১৪ জুলাই রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে কোটা ব্যবস্থার পক্ষে জোরালোভাবে কথা বলার পরে পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয়, যদিও তিনি বলেছিলেন যে, বিষয়টি এখন আদালতে থাকায় এই বিষয়ে সরকারের কিছু করার নেই।

তিনি জোর দিয়ে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা বহাল রাখতে হবে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয়-স্বজনের জন্য কোটার বিরোধিতাকারীদের ‘রাজাকার’-এর সাথে তুলনা করেন।

তাঁর মন্তব্যকে আন্দোলনের প্রতি অবমাননা হিসেবে গণ্য করে মধ্যরাতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভে নেমে পড়ে।

বিক্ষোভকারীরা নিজেদের 'রাজাকার' বলে পরিচয় দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতা যুদ্ধকে হেয় করেছে অভিযোগ করে ক্ষমতাসীন দলের মহাসচিব ওবায়দুল কাদের সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ছাত্রলীগের সদস্যরা 'ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণের' ‘যথাযথ জবাব দিতে প্রস্তুত'।

পরদিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে ছাত্রলীগ ও পুলিশ সদস্যরা নারকীয় তাণ্ডবে নামে। দিন শেষে মৃতের সংখ্যা ছয়ে দাঁড়ায়ে।

অন্তর্নিহিত কারণ কী?

প্রশ্ন আসে, দেশে যেখানে প্রতি বছর কমপক্ষে চার লাখ স্নাতক বের হচ্ছে, সেখানে বছরে হাজার তিনেক সিভিল সার্ভিসের চাকরিতে সমান সুযোগের জন্য কেন লাখ লাখ শিক্ষার্থী আন্দোলন করছে? কেনই বা দাবানলের মতো তা ছড়িয়ে পড়ছে?

বর্তমান আন্দোলনের পেছনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্ররোচনা না থাকলেও, এতে ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ শুধু সরকারি চাকরিতে সমান সুযোগের দাবিতে নয়, বরং এ হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অসন্তোষের বিস্ফোরণ।

ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা যখন সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, গত দুই দিনে ছাত্ররা অনেক জায়গায় রুখে দাঁড়িয়েছে এবং তাদেরকে পাল্টা ধাওয়া দিয়েছে।

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা অন্যদের তাড়িয়ে দখল করে রেখেছে। ছাত্রাবাসগুলোকে জোরপূর্বক ছাত্রলীগের নিয়োগ কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে। সেখানে বসবাসরত ছাত্রদের শাসক দলে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়।

শাসক সমর্থকরা তাঁদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য দায়মুক্তি ভোগ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসকরা তুচ্ছ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য তাদের অপরাধ কর্মের সহায়ক হয়। এগুলো শুধু ছাত্রদের জীবনকে অসহনীয় করে তোলেনি বরং তাদের মর্যাদাও ক্ষুণ্ণ করেছে। এই আন্দোলনকে শিক্ষার্থীরা তাদের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের একটি উপায় হিসেবে দেখছে।

এ আন্দোলন এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি হতাশার প্রতিফলনও বটে, যা উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের দাবি সত্ত্বেও খুব কম কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৩ সালের শেষের দিকে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়স্ক ৩৯ শতাংশেরও বেশি যুবক চাকরিতে বা শিক্ষায় নেই। অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি ২২ লাখ মানুষ কিছুই করছেন না।

অবশ্য অর্থনীতিবিদরা না মানলেও সরকার দাবি করেছে বেকারত্বের হার মাত্র ৩.৩%। সরকারের এই হিসাব মানলেও অন্তত ২৩ লাখ ৫০ হাজার মানুষ চাকরির বাইরে আছে।

গত কয়েক দশক ধরে অনুসৃত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বার্ষিক চাকরির বাজারে প্রবেশকারী ২০ লাখ মানুষের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে।

অন্যদিকে সরকারের দোসররা কোটি কোটি টাকা লুটপাট করছে, যা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

প্রাক্তন সেনাপ্রধান, প্রাক্তন পুলিশ প্রধান, কর কর্মকর্তা, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীর দুর্নীতির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো বর্তমান সরকারের অধীনে কীভাবে একটি দুর্বৃত্তায়িত ব্যবস্থার উদ্ভব এবং বিকাশ ঘটেছে তার কিছু উদাহরণ মাত্র।

এদিকে যারা রাজপথে বিক্ষোভ করছেন তাঁরা ভোট দেওয়ার যোগ্য হওয়ার পর থেকে একটিও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি। ফলে তারা রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে ভাবছেন।

BD-c-pic.jpg
শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী এক শিক্ষার্থী পুলিশকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়ছেন। ১৭ জুলাই ২০২৪। [বেনারনিউজ]

সরকার কেন কঠোর

শেখ হাসিনার সরকার নানা সমস্যায় ভুগছে যার প্রতিকার করতে পারছে না। বৈদেশিক রিজার্ভ কমছেই এবং মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছেই। উঁচু পর্যায়ের দুর্নীতির প্রতিবেদনগুলো শাসককে অস্বস্তিতে ফেলেছে। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় এবং ২০২২-২০২৩ সালে পাকিস্তানে তৃণমূল থেকে সংঘটিত স্বতঃস্ফূর্ত সরকারবিরোধী আন্দোলনের দৃষ্টান্তে তাঁরা শঙ্কিত।

তবে ক্ষমতাসীনদের জন্যে সব চেয়ে ভয়ের বিষয়, ২০০৯ সালের জানুয়ারির পর শেখ হাসিনার সামনে এটি প্রথম সরাসরি ও প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ। এই সময়ে জনগণ আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের সমালোচনা করেছিল, কিন্তু কেউ শেখ হাসিনার সরাসরি সমালোচনা করেননি।

জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে সরকার জনগণের ম্যান্ডেট পায়নি, কারণ বিরোধীরা বর্জন করেছিল। ফলে তাঁরা জনগণের সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে পারছে না। তাই শক্তি প্রয়োগ ব্যতীত ক্ষমতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তেমন কোনো অস্ত্র এদের হাতে নেই।

তবে এসব করে তারা ইতিমধ্যে তৈরি হওয়া একটা বাজে পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলবে, যা অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত সমাজের অন্যান্য অংশগুলোকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে যোগদানের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

সেটা হবে সত্যিকারের গণঅভ্যুত্থান।

 

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সরকার বিভাগের বিশিষ্ট অধ্যাপক (ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর) এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো।

নিবন্ধের মতামত ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, আটলান্টিক কাউন্সিল বা বেনারনিউজের অবস্থানের প্রতিফলন নয়, লেখকের নিজস্ব।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: পুলক ঘটক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।