বজ্রপাতে নিহতের সংখ্যা বাড়লেও সরকারের কাছে এটা দুর্যোগ নয়

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.05.16
2016-05-16-Lightning-story620.jpg খোলা জায়গা বিশেষ করে কৃষি জমিতে কৃষকেরা অবস্থান করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ কারণে বজ্রপাতে কৃষকের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। মে ১৫, ২০১৬।
ফোকাস বাংলা

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। এর সঙ্গে বেড়েছে নিহতের ঘটনাও। গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারে বজ্রপাতে সারা দেশে কমপক্ষে ৫৭ জন মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

সাধারণত গ্রামাঞ্চলে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা দেখা গেলেও শহরে তা বিরল। এবার রাজধানী ঢাকায় মারা গেছে দুজন।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার, মোবাইল ফোনের ব্যবহার প্রভৃতিকেই বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বজ্রপাত এখনো দুর্যোগ নয়

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে বজ্রপাতে মৃত্যুর কোনো হিসাব নেই। কারণ সরকারের কাছে বজ্রপাত দুর্যোগ হিসেবে গণ্য হয় না। তালিকায় সুনামিকে দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও তা এখনও বাংলাদেশে আঘাত হানেনি।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে বজ্রপাতের কারণে। প্রাকৃতিক বা মানুষ সৃষ্ট একক কারণে এতো মৃত্যুর ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি।

বেসরকারি সংস্থা ডিজাস্টার ফোরামের হিসেবে, বজ্রপাতের কারণে ২০১০ সালে ১২৩, ২০১১ সালে ১৭৯, ২০১২ সালে ৩০১, ২০১৪ সালে ২১০ ও ২০১৫ সালে ২৭৪ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বেনারকে জানান, “গত কয়েকদিনে বজ্রপাতে অর্ধশতাধিক মানুষ মারা গেছে। কিন্তু একে দুর্যোগের তালিকায় রাখেনি সরকার।”তিনি জানান, “বজ্রপাতে নিহতের পরিসংখ্যান বের করার দায়িত্ব দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু বজ্রপাত দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত না হওয়ায় সে হিসেব তাদের কাছে নেই।”

এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ বেনারকে বলেন, “বজ্রপাতে সাম্প্রতিক নিহতের বিষয়টি নিয়ে অধিদপ্তর ভাবছে।”

বজ্রপাত বেশি হওয়ার কারণ উষ্ণতা বৃদ্ধি

গত কয়েক বছরে বজ্রপাতের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল জানান, “গত এক শ বছরে পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বেড়েছে এক দশমিক ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উষ্ণতা বাড়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের আর্দ্র বায়ু ভূপৃষ্ঠের উষ্ণ বায়ুর সাথে মিলে ঘন মেঘ সৃষ্টি করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মেঘের ঘনত্ব ও পরিমাণ বাড়ছে যা বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটাচ্ছে।

অধ্যাপক মাকসুদ বলেন, “আমাদের দেশে বজ্রপাত নিয়ে বিস্তর গবেষণা না হলেও ব্রাজিলের বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে বজ্রপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।”

আরও যেসব কারণ দায়ী

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাতের ৯০ ভাগ আকাশেই শেষ হয়ে যায়। মাত্র ১০ ভাগ মাটিতে নেমে আসে। বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ার জন্য বেশ কিছু বিষয়কে দায়ী করছেন তারা।

“সাধারণত সন্ধ্যার দিকে বজ্রপাত বেশি হয়। আর তা খোলা জায়গায় আঘাত হানে বেশি। গ্রামাঞ্চলে বড় বড় গাছ বিদ্যুৎ পরিবাহী হিসেবে বজ্রপাত থেকে বিদ্যুৎ টেনে নিত। এখন বড় গাছের পরিমাণ কমে গেছে। এ ছাড়া মানুষ আগের চেয়ে বেশি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে, যা বিদ্যুৎ পরিবাহী হিসেবে কাজ করছে,” জানান বিশেষজ্ঞ মাসুদ কামাল।

খোলা জায়গা বিশেষ করে কৃষি জমিতে এখন সন্ধ্যার পরেও কৃষকেরা অবস্থান করেন। এ কারণে তাদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া কৃষি জমিতে যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়ে গেছে; বিশেষ করে মোবাইল ফোনের ব্যবহার বজ্রপাতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া ভবনে বজ্রনিরোধক বা আর্থিং না করাও বজ্রপাতে প্রাণহানির জন্য দায়ী বলে মনে করছেন তারা।

বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের সদস্য সচিব গওহর নাইম ওয়ারা বেনারকে বলেন, “বিল্ডিং কোডেই বলা আছে ভবনে আর্থিং করার কথা; বিশেষ করে ৩৩ মিটারের বেশি উঁচু ভবনের ক্ষেত্রে। সচেতনতা ও কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে এখন বেশিরভাগ উঁচু দালান কিংবা ভবনেই তা দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়াও বড় বড় গাছপালার অভাবে গ্রামাঞ্চলের অনেক বাড়িঘরও ঝুঁকিতে আছে।”

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ১০ আগস্ট সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার সরস্বতীপুর গ্রামে এক অস্থায়ী মসজিদের ওপর বজ্রপাতে নিহত হয়েছিল ওই মসজিদের ইমামসহ ১৩ জন মুসল্লি। খোলা জায়গায় মৃত্যুর ঘটনা অনেক ঘটলেও ঘরের ভেতর বজ্রপাতে নিহতের এমন ঘটনা বিরল।

উত্তরণের উপায় ও করণীয়

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বজ্রপাতের সময় ভবনের নিচে আশ্রয় নেওয়া এবং সেসব বস্তু বিদ্যুৎ সুপরিবাহী সেসব থেকে দূরে থাকতে হবে। ঝড়-বৃষ্টির সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার না করার পরামর্শ তাদের। বেশি গাছ লাগানোর পাশাপাশি বড় গাছ কাটতে না দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন তারা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ বলেন, “বজ্রপাত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এ সমস্যা থেকে উত্তরণে করণীয় ঠিক করা হবে। এ জন্য গবেষণার প্রয়োজনও আছে।”

গওহর নাইম ওয়ারা বলেন, “গত পাঁচ বছরের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্টই বোঝা যায় মে মাসে বজ্রপাতের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। আর খোলা জায়গা যেখানে বেশি, বিশেষ হাওর এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সুতরাং এসব বিষয় মাথায় রেখে পরিকল্পনা করা কঠিন কিছু না। এ জন্য প্রয়োজন সরকারের স্বদিচ্ছা।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।