এক বছরের ব্যবধানে বদলে গেছে ছিটমহলের চেহারা

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.08.01
20160801-BD-ChitMahal1000.jpg বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন ছিটমহলের নারীরা। জুলাই ২৯, ২০১৬।
বেনার নিউজ

সাবেক ছিটমহল নামের বিচ্ছিন্ন জনপদগুলো এখন বাংলাদেশের অংশ।শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব ক্ষেত্রেই এ দেশের নাগরিকদের মতোই সুবিধা পাচ্ছে সেখানকার বাসিন্দারা। দীর্ঘ বঞ্চনা আর লাঞ্ছনার ইতিহাস পেছনে ফেলে আলোকিত জীবনের স্বপ্নে বিভোর তাঁরা।

গত বছরের পহেলা আগস্ট সীমান্ত চুক্তি কার্যকরের পর বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে থাকা ভারতের ১১১ টি ছিটমহল এ দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর থেকেই দিন বদলের গল্প শুরু হয় ছিটমহলবাসীদের।

ছিটমহলে উন্নয়নের ছোঁয়া

মাত্র এক বছরের ব্যবধানে অনেকটাই বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের চিত্র। অন্ধকার এলাকা বলে পরিচিতি পাওয়া ছিটমহলগুলোতে এসেছে বিদ্যুৎ সংযোগ। এখন ঘরে আলো জ্বলে, বৈদ্যুতিক পাখা ঘোরে।

সরেজমিন দেখা যায়, এলাকাবাসীকে পানি ও পয়োনিষ্কাশন সুবিধা দিতে প্রশাসন, বেসরকারি সংস্থা ও বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে স্থাপন করা হয়েছে নলকূপ ও স্যানিটারি টয়লেট। স্থাপনা করা হয়েছে স্কুল, মাদ্রাসা ও অস্থায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্র।

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার গোতামারিতে দেখা গেল, সাত লাখ টাকা ব্যয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। কুড়িগ্রামের দাসিয়ারছড়ায় ডিজিটাল তথ্য ও সেবাকেন্দ্রে ব্যবহার করা হচ্ছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। এরই মধ্য চালু করা হয়েছে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা।

দাসিয়ারছড়ার প্রধান সড়কটিতে ইট বিছানো হয়েছে। শিগগির পাকা করা হবে রাস্তাঘাট।এরই মধ্যে শুরু হয়েছে বাংলাদেশের নতুন নাগরিকদের ভোটার তালিকায় নাম নিবন্ধনের কাজ। আর এসব উন্নয়নে সন্তোষ প্রকাশ করেন স্থানীয়রা।

দাসিয়ারছড়ার কালিরহাটের কৃষক আবদুর রহমান বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ হওয়ায় পর এখন অনেক সুবিধা পাচ্ছি। বিদ্যুৎ আসায় সেচের খরচ কমেছে। সড়ক মেরামত করায় পণ্য পরিবহনেও সুবিধা হচ্ছে।”

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার গোতামারির বিলুপ্ত ছিটের বাসিন্দা বৃদ্ধ আসরউদ্দিন বেনারকে বলেন, “আগে বাংলা কিংবা ভারত কেউই আমাদের নিত না। এখন বাংলাদেশে হওয়ার পর দিব্যি বাজার, হাট, কোর্ট-কাচারিতে যাতি পারতিছি। এখন আর কেউ আটকাবার নয়।”

দসিয়ারছড়ার একটি মাটির রাস্তায় তিন কিলোমিটার ইট বিছানো হয়েছে ফটোঃবেনার নিউজ

শিক্ষার্থীদের মধ্যে আশার আলো

এক সময় পরিচয় গোপন করে বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে লেখাপড়া করতো ছিটমহলের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এখনকার চিত্র ভিন্ন।

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার গঙ্গারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র দুলাল জানাল, “আগে হীনমন্যতায় ভুগতাম, নিজেদের পরিচয়ে স্কুলে আসতে পারতাম না। পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেলেও অবহেলার শিকার হতাম। এখন বুক ফুলিয়ে স্কুলে যাই।নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি।”

ছিটমহলের অনেক যুবক শিক্ষিত হলেও শুধু ছিটের নাগরিক হওয়ায় এতদিন কোনো চাকরি পাননি। দীর্ঘদিনের সে বঞ্চনা ঘোচাতে সকল চাকরিতে কোটা সুবিধা চাইলেন তারা।

বিলুপ্ত বাঁশকাটা ছিটমহলের যুবক আনিস বলেন, “ছিটের বাসিন্দা হওয়ায় মাস্টার্স পাশ করার পরেও কোনো চাকরি পাইনি।ছিটের বাসিন্দা হওয়ায় পুলিশ ভেরিফিকেশনের পর আবেদনপত্র বাতিল হয়ে যেত।”

একই গ্রামের মুজাহিদ বলেন, “আমরা স্বামী-স্ত্রী উভয়েই শিক্ষিত হয়েও ছিটে বাস করায় চাকরি পাইনি। এখন সরকারি চাকরির বয়স নাই। তাই সরকারের কাছে আবেদন, বিশেষ বিবেচনায় বিলুপ্ত ছিটের লোকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হোক।”

অবশ্য এরই মধ্যে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ—বিজিবিতে ছিটমহল কোটায় চাকরি পেয়েছেন কয়েকজন। এঁদেরই হাতীবান্ধা উপজেলার গোতামারির জাহিদুল ইসলাম।

তাঁর বাবা আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ হয়ে গেল ছিটের কোটায় বিজিবিতে চাকরিও হয়ে গেল। এখন আমার মতো সুখ এই ছিটে কেউ ভোগ করতে পারতেছে না।”

আছে দুর্নীতির অভিযো

কুড়িগ্রামের দাসিয়ারছড়া ছিটমহলে উন্নয়নের যে চিত্র দেখা গেল; তার থেকে বেশ পিছিয়ে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার বিলুপ্ত গোতামারি ছিটমহল। স্থানীয়দের অভিযোগ বাড়ি বাড়ি টিউবওয়েল দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয়েছে ২৫টি। এ ছাড়া যে টয়লেটগুলো স্থাপন করা হয়েছে তা অত্যন্ত নিম্নমানের। ভারী বর্ষায় সেগুলো ভেঙে যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে হাতীবান্ধা উপজেলার এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী অজয় কুমার সরকার বেনারকে বলেন, “এখানে এনজিও, বেসরকারি ব্যাংকসহ কয়েকটি সংস্থা আলাদা করে টয়লেট তৈরি করেছে। এটুকু বলতে পারি, আমরা যে টয়লেট স্থাপন করেছি তাতে কোনো দুর্নীতি হয়নি। তবে এগুলো কম বাজেটে তৈরি।”

এছাড়া বয়স্ক ও বিধবা ভাতা সবাই না পাওয়া, খুঁটির পরিবর্তে গাছের সঙ্গে বিদ্যুতের তার টানানোর মতো অভিযোগও রয়েছে।

পাটগ্রামের বিলুপ্ত ভোটবাড়ি ছিটের বাসিন্দাদের অভিযোগ, ৬৮ বছরের পুরোনো বঞ্চনার জীবনই রয়ে গেছেন। স্থানীয় বাসিন্দা শরীফ বলেন, “পুরো ভোটবাড়িতে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধীকে একটি মাত্র টয়লেট দেওয়া হয়েছে। আর টিউবওয়েল দেওয়া হয়েছে মাত্র তিনটি ।”

এ প্রসঙ্গে লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমি প্রত্যেক এলাকায় গিয়ে আমার মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে এসেছি। কিন্তু এমন কোনো অভিযোগ আমি পাইনি।”

তিনি আরও জানান, “বিলুপ্ত ছিটমহলের উন্নয়নে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। রাস্তা, স্কুল নির্মাণের পাশাপাশি ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ চলছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হবে।

তবে বাংলাদেশের বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও ভিন্ন চিত্রের খবর মিলেছে ভারতে। সোমবার দৈনিক প্রথম আলো এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ভারতীয় যুক্ত ছিটমহলগুলোর বাসিন্দাদের অনেকেই বলেছেন, তাঁদের স্বপ্ন ভেঙে গেছে।

সাবেক ভারত—বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় কমিটির সহসম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, অনেকেই এখন হতাশ হয়ে পড়েছেন। ফিরে গেছেন অনেকে। ফিরে যেতেও চাইছেন অনেকে।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ আইনজীবী রেডক্লিফ ভারত-পাকিস্তানের সীমানা টানার পরই মূলত জন্ম হয় ছিট মহলের। দীর্ঘ ৬৮ বছর পর গত বছরের পহেলা আগস্ট রাত ১২টা এক মিনিটে ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্ত চুক্তি এবং ২০১১ সালের প্রটোকল অনুযায়ী দু’দেশের সীমান্ত সমস্যার নিষ্পত্তি হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।