প্রতিবেশী রাজ্য ত্রিপুরা সাময়িকভাবে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড ব্যবহার করতে পারবে
2016.08.18

ভারতের আসাম থেকে মেঘালয় হয়ে ত্রিপুরায় ডিজেল, কেরোসিন ও তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসসহ জ্বালানি পরিবহণে আংশিক সড়কপথ ব্যবহারের সাময়িক অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ত্রিপুরার প্রতি মানবিক কারণেই এ অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সরকার।
বন্ধুপ্রতিম দেশের প্রয়োজনে এ ধরনের মানবিক সহায়তা নতুন নয়। এর আগেও কলকাতা থেকে ত্রিপুরা রাজ্যে ৩৫ হাজার টন চাল পাঠাতে বাংলাদেশ ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছিল।
মানবিক কারণে প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের উপকারে বাংলাদেশ সরকারের এ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। পাশাপাশি এ ধরনের পরিবহন সুবিধা দিয়ে রাজস্ব আয়ের বিষয়টিও ভাবার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
জ্বালানি পরিবহনে চুক্তি স্বাক্ষর
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ত্রিপুরায় জ্বালানি তেলবাহী ট্রাক-লরি সাময়িকভাবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে। বৃহস্পতিবার দু’দেশের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়েছে।”
তবে ওই সড়কের ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বাবদ নির্ধারিত ফি দিতে রাজি হয়েছে ভারত। চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে হলে এর সময় শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ আগে আলোচনা করে দুই পক্ষ এটি বাড়াতে পারবে।
এর আগে গত মঙ্গলবার পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা সাংবাদিকদের বলেন, “আশা করছি এ মাসের মধ্যে তেল পরিবহন শুরু হবে।”
যে কারণে এই মানবিকতা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, সম্প্রতি ভারী বর্ষণ এবং পাহাড়ি ভূমিধ্বসের কারণে আসাম হতে ত্রিপুরাগামী সড়কপথ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ত্রিপুরার সঙ্গে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের যোগযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। ফলে এ রাজ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসহ জ্বালানি তেলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে এবং ব্যাপক দুর্ভোগে পড়েছে ত্রিপুরার সাধারণ মানুষ। জ্বালানির অভাবে রাজ্যটির পরিবহন ক্ষেত্রেও দুরবস্থা চলছে।
এই অবস্থা নিরসনে ও মানবিক কারণে আসাম থেকে ত্রিপুরায় জ্বালানি তেল ও এলপিজি পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের আংশিক সড়কপথ ব্যবহারের অনুমতি চায় ভারত।
“এমন অবস্থায় দুদেশের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, ত্রিপুরার জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বন্ধন এবং সর্বোপরি মানবিক অবস্থা বিবেচনায় বাংলাদেশের সড়কপথ ব্যবহার করে করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে,” জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ত্রিপুরার সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত মহিউদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল ত্রিপুরার জনগণ। সে ঋণ শোধ হওয়ার নয়। তাই ত্রিপুরার এমন দুর্দিনে পাশে থেকে যথার্থ করেছে সরকার।”
বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট
দুদেশের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশের তামাবিল সীমান্ত চেকপোস্ট দিয়ে ভারতীয় জ্বালানিবাহি ট্রাক প্রবেশ করে সিলেট ও মৌলভীবাজারের প্রায় ১৪০ কি.মি. পথ অতিক্রম করে মৌলভীবাজারের চাতলাপুর চেকপোস্ট দিয়ে ত্রিপুরায় প্রবেশ করবে।
জানা যায়, পণ্য পরিবহন দুই দেশের মধ্যে আই ডব্লিউ টিটি-এর প্রটোকল থাকলেও এর আওতায় বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের একস্থান থেকে অন্য স্থানে পণ্য পরিবহনে তামাবিল এবং চাতলাপুর রুটের কথা উল্লেখ নেই। ফলে নতুন করে ভিন্ন সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে এ পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে।
এর আগে কলকাতা থেকে ত্রিপুরা রাজ্যে ৩৫ হাজার টন চাল বাংলাদেশ ভূখণ্ড ব্যবহার করে পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তেমনিভাবে বাংলাদেশ ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপালে ভয়ংকর ভূমিকম্পের পরে ত্রাণ পাঠিয়েছিল।
বাণিজ্যিক ভাবেও ভাবার পরামর্শ
নতুন এই পথে ভারতের একটি রাজ্য থেকে আরেকটি রাজ্যে পণ্য পরিবহন সুবিধা দিয়ে প্রতিবেশী দেশটির কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ভবিষ্যতে এ বিষয়টি ভাবার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে সিপিডির অতিরিক্ত গবেষক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বেনারকে বলেন, “এ ধরনের মানবিক ক্ষেত্রে চার্জের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তবে এটা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। এ ধরনের পরিবহন ভারতের জন্য সুবিধাজনক। তাই ভবিষ্যতে এটা বাণিজ্যিকভাবে দেখা উচিত। সে অনুযায়ী শর্তাবলি নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা হতে পারে।
এ ক্ষেত্রে আগে ভারতের সঙ্গে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে যে শর্তাবলি রয়েছে, সেগুলোকে ব্যবহার করে নতুন বাণিজ্যিক শর্ত বিবেচনা করে দেখা পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
সম্ভাবনার কথা জানিয়ে এই গবেষক বলেন, “ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর ভিতরে বাংলাদেশের এক ধরনের বাণিজ্য সুবিধা রয়েছে। তেমনি ভারতের একটা রাজ্য থেকে আরেকটি রাজ্যে পণ্য পরিবহনের সুবিধা যদি বাংলাদেশ বাণিজ্যিকভাবে দিতে পারে, তাহলেও রাজস্ব প্রাপ্তির একটা সুযোগ রয়েছে।”
এর আগের চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশের ভূখণ্ড দিয়ে ভারতীয় পণ্য পরিবহনে টনপ্রতি মাত্র ১৯২ টাকা মাশুল ধরা হয়। এবারও একই মূল্য নির্ধারিত হয়েছে বলে জানা যায়।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “ভারতের তেলবাহী ট্যাংকার পরিবহনে প্রতি টনে ১৯২ টাকা মাশুল ধার্য করা হয়েছে। মূলত আর্থিক লাভের চেয়ে মানবিক সাহায্যের বিষয়টি বড় করে দেখা হচ্ছে”।
এই নামমাত্র মাশুল নিয়ে সমালোচনা থাকলেও বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশ পর্যাপ্ত সুবিধা দিতে পারলে এ মাশুল কয়েকগুন বাড়বে।
এ বিষয়ে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “পূর্ব নির্ধারিত মাশুলে সব ধরনের ব্যয় কার্যকর হয়নি। যেমন নদী শাসন, ড্রেজিং বা নদী শাসন বা পণ্য পরিবহনে নিরাপত্তাসহ সকল ধরনের ব্যয় ধরা হলে ১৯২ নয়, প্রায় আটশো টাকার মত মাশুল আসবে।”
তিনি বলেন, “ভবিষ্যতে যখন পুরোপুরি এ রুটগুলো চালু হবে এবং বাংলাদেশ যখন পর্যাপ্ত সুবিধা দিতে পারবে, তখন সে অনুযায়ী মাশুলের হারও সমন্বয় হবে। তাই আমার মনে হয় পুরো বিষয়টাই বাণিজ্যিকভাবে বিবেচনা করা উচিত।”