গরু নিয়ে দুই দেশের টানাপোড়েন, মাংসের দাম বাড়ছে
2015.04.07

রাজধানীর ঐতিহ্যবাহি পুরানো বাজার হাতিরপুলে ৭ এপ্রিল গিয়ে দেখা যায়, প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে একদাম ৩৭০ টাকায়। চার মাস আগেও প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল ২৮০ টাকা।
মাংস ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তা আরও বাড়তে পারে। কেজিপ্রতি ইতিমধ্যে ৯০ টাকা দাম বেড়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়া।
মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে গরুর মাংস খুবই জনপ্রিয়, যা ছাড়া সামাজিক আচার–অনুষ্ঠানের আপ্যায়ন পর্ব চিন্তাই করা যায় না।
কিন্তু বাংলাদেশিদের গরুর মাংস খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করানোর জন্য ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে গবাদি পশুর চোরাচালান পুরোপুরি বন্ধ করতে ১ এপ্রিল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের প্রতি আহ্বান জানান দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। তাঁর মতে, দাম অস্বাভাবিক বাড়লে বাংলাদেশিরা গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দেবে।
এ প্রসঙ্গে ৩ এপ্রিল টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএসএফ জওয়ানরা বাংলাদেশে গরু পাচার পুরোপুরি বন্ধ করে দিলে দেশটির আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ হবে ৩১ হাজার কোটি রুপিরও বেশি।
“দুই দেশের পলিটিক্যাল বর্ডার আসলে ইকোনোমিক বর্ডার হিসেবে কাজ করছে। গরুর যোগান কমেছে, কিন্তু চাহিদা থাকায় দাম বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক,” বেনারকে জানান অর্থনীতিবিদ এ কে মনোওয়ার উদ্দিন আহমদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ওই অধ্যাপকের মতে, চোরাচালান বন্ধ করার বিষয়টি নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য। কিন্তু এর ফলে দুই দেশের সরকারি কোষাগারে কর যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ভারতই বেশি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে।
ড. মনোয়ার বলেন, এখনও কিন্তু আমদানি ও রপ্তানিকারকরা ঘুষ হিসেবে টাকা খরচ করছে, যদিও সেটির বেশিরভাগই যাচ্ছে উভয় সীমান্তের পাহারাদারদের কাছে। তাঁর মতে, বৈধভাবে আসলে এর সুবিধা বাংলাদেশের ভোক্তারা পেত। যদিও সেই সম্ভাবণা ক্ষীণ।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের বিভিন্ন গোশালায় প্রায় সোয়া এক কোটি গরু রয়েছে। এসব গরুর স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু পর্যন্ত লালন-পালন করতেই এই পরিমাণ হবে। যা ভারতের শিশুদের পুষ্টির জন্য ‘সমন্বিত শিশু উন্নয়ন প্রকল্পের’ আওতায় ভারত সরকার যে বরাদ্দ দেয় এই অর্থ তার চারগুণ।
ভারতের এই সিদ্ধান্তে লাগামহীনভাবে গরুর মাংসের মূল্য বাড়লেও বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত চুপচাপ রয়েছে। অন্যদিকে ভোক্তারা গরুর মাংসের দোকানের সামনে গিয়ে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হচ্ছেন।
“আমরা কী আর ইচ্ছা করে দাম বাড়িয়েছি। এটা বিক্রি করেই তো আমাদের সংসার চালাতে হয়,” বেনারকে জানান হাতিরপুলের মাংস দোকানের মালিক মো. মোবারক হোসেন।
তাঁর মতে, কেজিতে দাম ইতিমধ্যে ৯০ টাকা বাড়লেও তা আরও বাড়বে। দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ে এর মীমাংসা হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
রাজধানীর বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য দেখভালের দায়িত্ব ঢাকা সিটি করপোরেশনের।কিন্তু এই পরিস্থিতিতে করপোরেশনেরও করার কিছু নেই।
“দাম যেন মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে সে জন্য মূল্য তালিকা করা হয়। নানা কারণে ব্যবসায়ীরা মানতে পারছে না। তাঁদের সঙ্গে বসে খুব শিগগির এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” জানান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মাসুদ আহসান।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, প্রতি বছর বাংলাদেশে পাচার হয় ২৫ লাখ গরু। যদি পাচার একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া হয় তবে পড়ে থাকা সোয়া কোটি গরুকে স্বাভাবিক মৃত্যু পর্যন্ত লালন-পালন করতে হবে। সরকারের এই উদ্যোগের কড়া সমালোচনা করছে ভারতের বেশিরভাগ গণমাধ্যম।
মাংস ব্যবসায়ী সমিতি অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে বলছে, সীমান্তে কড়াকড়ির কারণে ভারত থেকে গরু আমদানি অস্বাভাবিক কমে গেছে। কিছুদিনের মধ্যে সরবরাহ স্বাভাবিক না হলে এ দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন মাংস ব্যবসায়ীরা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, নিউমার্কেট ও মিরপুর-১ নম্বরের বাজার ঘুরে দেখা যায়, গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৩৬০-৩৮০টাকায়।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের খুচরা বাজারদরের তালিকা অনুয়ায়ী, এ বছরের ১ জানুয়ারি তা ছিল ২৮০টাকা।
“ মাংসের বাজার এখন আন্তর্জাতিক হয়ে গেছে। ভারত থেকে যদি গরু আসতো তাইলে দাম কমতো। একরেট ৩৬০টাকা ব্যেইচাও লোকসান হচ্ছে,” বেনারকে জানান কারওয়ান বাজারের গরুর মাংস ব্যবসায়ী মো. মজিবুর রহমান।
গরুর মাংসের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে অন্যান্য মাংসের দামেও। বছরের শুরুর দিকে ব্রয়লার মুরগীর দাম ছিল কেজি প্রতি ১৩০ টাকা। তা এখন ১৬০-১৬৫টাকা। আর খাসীর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৫৫০-৬০০টাকায়। বছরের শুরুতেও যা ছিল ৪৫০ টাকা।
“ এখন যে যেভাবে পারছে দাম বাড়াচ্ছে, সবাই তাতেই কিনতে বাধ্য হচ্ছি। বাজারে আসলে মনে হয় ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণের কেউ নেই,” ক্ষোভের সঙ্গে বেনারকে জানান হাতিরপুলে বাজার করতে আসা ফোন–ফ্যাক্সের দোকানদার তোফায়েল আহমেদ (৪৭)।
বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির হিসেব মতে, রাজধানীতে ছয় শতাধিক মাংসের দোকান আছে। পশু সরবরাহ কমে যাওয়ায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অনেক মাংসের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে।
“সামনে রমজান আসছে, সরকার দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে মাংস ব্যবসায়ীরা কী করবে এবং কত দোকান বন্ধ হবে তা বুঝতে পারছি না,” জানান সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম।
অধ্যাপক মনোওয়ার বলেন, “এত পণ্য থাকতে গরু নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। দুই দেশই এই জটিল বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বক্তব্য না দিয়ে যদি বাস্তবতার আলোকে আলাপ–আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে এই অস্থির অবস্থার অবসান হতে পারে।”