বাংলাদেশ–ভারত সীমান্ত জুড়ে বিএসএফের প্রাণঘাতী গুলি বর্ষণ বাড়ছে

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.05.14
BD-Ind সীমান্তে বিএসএফ সদস্যরা টহল দিচ্ছে। এপ্রিল,২০১৫
বেনার নিউজ

অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ আবারও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করায় বাংলাদেশে ও ভারতের মধ্যে চলমান স্বস্তির মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি তৈরি করছে। ২০১১ সালে কিশোরী ফেলানি নিহত হওয়ার পর বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে বিএসএফ সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করার কথা বলেছিল।

কিন্তু বিএসএফ এর হাতে গত জানুয়ারি থেকে ১৪ মে পর্যন্ত কমপক্ষে ১৫ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে এপ্রিল মাসেই আটজন নিহত ও আরও অন্তত সাতজন নির্যাতিত হয়েছেন। বাংলাদেশের বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্র এবং অধিকারের হিসেব থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

সর্বশেষ ১৪ মে বুধবার গভীর রাতে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়নে মাস্টারবাড়ি সীমান্তের মেইন পিলারের কাছে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি যুবক অন্তর ইসলাম (২৭)  নিহত হন। তিনি বুড়িমারী রেলওয়ে কলোনীপাড়ার আমিনুর ইসলামের ছেলে। তার লাশ বিএসএফ নিয়ে গেছে।
“এর প্রতিবাদ জানিয়ে এবং লাশ ফেরত চেয়ে বিজিবির পক্ষ থেকে বিএসএফকে পতাকা বৈঠকের আহ্বান করা হয়েছে,” বেনারকে জানান বিজিবি লালমনিরহাট-১৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আহমদ বজলুর রহমান হায়াতী।

ভারত থেকে গরু আনতে অন্তরসহ কয়েকজন সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে গিয়েছিলেন। তারা ফেরার পথে এ ঘটনা ঘটে।  

“সীমান্ত পার হওয়ার সময় অন্তর ও তার সঙ্গীদের দেখে বিএসএফ ব্যাটালিয়নের চ্যাংরাবান্ধা ক্যাম্পের একটি টহলদল গুলি ছোড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই অন্তরের মৃত্যু হয় এবং রাজু নামে আরেক বাংলাদেশি আহত হন, জানান বজলুর রহমান। গ্রেপ্তার ও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের ভয়ে রাজু কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারেন বলে ধারণা করছেন স্থানীয়রা।  

পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল ইসলাম বলেন, আজ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে ওই যুবকের(অন্তর)লাশ বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে বিএএসএফ। এর পর পুলিশ নিহতের বাবা আমিনুর রহমানের কাছে লাশ বুঝিয়ে দেয়।

২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রাম সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে কিশোরী ফেলানি নিহত হয়। কাঁটাতারের বেড়ায় ফেলানির ঝুলে থাকা লাশ দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে ২০১২ সালে বিএসএফ ও ভারত সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র বন্ধ করার কথা বলা হয়।

বিষয়টি নিয়ে দুটি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়েও আলোচনা হয়। এরপরে সীমান্তে হত্যা অনেকখানি কমে যায়। চলতি বছর থেকে সেই সংখ্যা আবারও বাড়তে শুরু করেছে।

গত ২ এপ্রিল ভারতের প্রভাবশালী দ্যা হিন্দু পত্রিকা কেন্দ্রীয় স্বদেশ (স্বরাষ্ট্র) মন্ত্রী রাজনাথ সিংকে উদ্ধৃত করে সংবাদ প্রকাশ করে যে সীমান্তে প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র ব্যবহারের কৌশল থেকে সরে আসছে ভারত।

রাজনাথ সিং চব্বিশ পরগনা জেলায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পরিদর্শন করে গণমাধ্যমকে বলেন, “নন-লেথাল অস্ত্র ব্যবহারের কৌশলের মতো আর কিছুই নেই। কিন্তু মুখ্য বিষয়টি হচ্ছে আমাদের সীমান্ত সুরক্ষিত করা। বিএসএফ জওয়ানরা আক্রমণের শিকার হবেন আর তারা আত্মরক্ষায় গুলি ছুঁড়তে পারবেন না- আমি এ ধরণের পরিস্থিতি বরদাশত করবো না।”

গত ১১ এপ্রিল ভোরে যশোরের বেনাপোলের দৌলতপুর সীমান্তে বাংলাদেশের ভেতরে দুই বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ। নিহতরা হলেন, শার্শা উপজেলার পুটখালী গ্রামের অকো (২৯) ও ঝিনাইদহ সদর উপজেলার শান্ত (২৫)।

পুলিশ জানায়, শান্ত ও অকোসহ কয়েকজন ভারতে গরু আনতে যান। ফেরার পথে দৌলতপুর সীমান্তের কাগজপুকুর এলাকায় বিএসএফ সদস্যরা তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। অপরজনকে শার্শার নাভারণ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

এ হত্যাকাণ্ডের পরে বিজিবি ২৩ ব্যাটালিয়ন ঘটনার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানায়, বিএসএফ এর জন্য দুঃখ প্রকাশও করে। ওই ঘটনার তিন মাস আগেই পুটখালী সীমান্তের ইছামতি নদী থেকে এক বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার হওয়ার পরেও বিএসএফ দুঃখ প্রকাশ করেছিল।

“সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ঘটলেই আমরা প্রতিবাদ জানাই, বিএসএফ দুঃখ প্রকাশ করে। আর এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটবে না বলে তারা অঙ্গীকার করে। কিন্তু তারা অঙ্গীকার রক্ষা করে না,” বেনারকে জানান বিজিবি’র ২৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রহিম।

ওই কর্মকর্তা জানান, “আমরা তাদেরকে বলেছি, আপনারা গুলি চালাবেন না। আটক করে আমাদের কাছে হস্তান্তর করেন। কিন্তু অনেক সময় সেটাও তারা শোনেন না।”

গত ২২ এপ্রিল ঝিনাইদহের মহেশপুরের খোসালপুর সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে নিহত হয় হাসানুজ্জামান (১৬) নামে এক স্কুল ছাত্র। সে স্থানীয় বাকোসপোতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়ত।

নিহতের পরিবার জানায়, বুধবার রাতে গরু আনতে অন্যদের সঙ্গে সীমান্তে গিয়েছিল হাসান। এ সময় ভারতের রামনগর বিএসএফ ক্যাম্পের সদস্যরা গুলি চালালে হাসান মারা যায়। খোসালপুর গ্রামের গরু ব্যবসায়ী আজগর আলী ও আব্দুস সালামের রাখাল হিসাবে সে সীমান্তে গরু আনতে যেতো বলে গ্রামবাসী জানিয়েছে।

তবে হাসানুজ্জামানকে গুলির বিষয়টি অস্বীকার করেছে বিএসএফ।

এরপর ২৫ এপ্রিল ভোররাতে পঞ্চগড়ের ঘাগড়া সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে সামিউল হক (৩৫) নামে এক বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ী নিহত হন। বিজিবি ও স্থানীয়রা জানান, যশোরের মতো এখানেও সামিউলসহ একদল গরু ব্যবসায়ী গরু আনতে ঘাগড়া সীমান্ত এলাকায় যায়। ভারতের সিংপাড়া বিএসএফ ফাঁড়ির টহলরত সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি করে। এ সময় অন্যরা পালাতে পারলেও সামিউল হক ঘটনাস্থলে মারা যান। এই হত্যার দায়ও বিএসএফ অস্বীকার করেছে।

“দুটি দেশের সম্পর্কগত জায়গা থেকে যেখানে সীমান্তে হত্যা শূন্যতে নামিয়ে আনার কথা সেখানে সব মিলিয়ে ১৫টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিএসএফ’র প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের কথা নয়। তবুও তারা করছে। বিষয়টি দুটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বসে সুরাহা করতে হবে,” বেনারকে জানান দেশের মানবাধিকার কর্মী নূর খান, যিনি আইন ও সালিস কেন্দ্রের একজন পরিচালক।

গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর বিজিবি সদর দপ্তরে বিজিবি-বিএসএফের সপ্তাহব্যাপী সীমান্ত সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত যৌথ সংবাদ ব্রিফিংয়ে সীমান্ত হত্যা নিয়ে আলোচনা হয়।

ওই ব্রিফিংয়ে বিএসএফ মহাপরিচালক দেবেন্দ্র কুমার পাঠক বলেন, “একার পক্ষে সীমান্তে হত্যা বন্ধে কাজ করা সম্ভব নয়। তবে বিজিবি-বিএসএফ যৌথভাবে সীমান্তে হত্যা বন্ধে কাজ করতে চায়। এ রকম ঘটনাকে আমরা শূন্যে নিয়ে আসতে চেষ্টা করছি।”

বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করতে আগামী জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফর করবেন।  ১৯৭২ সালের ৯ মার্চ এ মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং ’৭৭ সালে তার মেয়াদ শেষ হয়। এরপর নতুন করে আর এ চুক্তি হয়নি। আগামী মাসে ঢাকা সফরে সে চুক্তিই সেরে ফেলতে চান মোদি।

“সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় স্থলসীমান্ত চুক্তি ভারতীয় পার্লামেন্টে অনুমোদন হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বিরাজ করছে।এখন সীমান্ত হত্যার মতো অমানবিক ঘটনাও বন্ধ হবে বলে আশা করা যায়,” জানান নূর খান।


মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।