বাংলাদেশ-ভারত বৈঠকে নিরাপত্তা ইস্যু গুরুত্ব পেয়েছে
2015.11.17

সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সহযোগিতা চেয়েছে ভারত। একসঙ্গে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার অঙ্গীকারের পাশাপাশি সীমান্তে হত্যা বন্ধে আবারও দিল্লিকে চাপ দিয়েছে ঢাকা। আর দিল্লির পক্ষে বরাবরের মত হত্যা ‘শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার’ আশ্বাস পাওয়া গেছে।
মঙ্গলবার শেষ হওয়া দুদিনব্যাপী বাংলাদেশ-ভারতের ১৭তম স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্তে উত্তেজনা ও হত্যা বন্ধ, অনুপ্রবেশ রোধ, মাদক প্রতিরোধ, নারী ও শিশু পাচার রোধসহ নানা বিষয়ে যৌথভাবে কাজ করতে পুনঃঅঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে প্রতিবেশি দুই দেশ। পাশাপাশি বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সহজ করা হবে বলেও আশ্বস্ত করেছে ভারত।
বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান এবং ভারতের পক্ষে দেশটির স্বরাষ্ট্র সচিব রাজীব মেহর্ষি নেতৃত্ব দেন।
বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা
দীর্ঘদিন আটক থাকা ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা) নেতা অনুপ চেটিয়াকে ফিরিয়ে দেওয়ায় বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়ে আরো উলফা, গারো ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মিসহ (জিএনএলএ) ২০টি বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ এদেশে সক্রিয় রয়েছে বলে ভারতের পক্ষ থেকে বৈঠকে জানানো হয়। তাদের দমনে বাংলাদেশকে আগাম তথ্য দিয়েও সহযোগিতা করতে চায় তারা।
তবে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোনো ঘাঁটি থাকার কথা অস্বীকার করেছে বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র সচিব মোজাম্মেল হক খান সাংবাদিকদের জানান, “ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোনো আস্তানা, তৎপরতা বাংলাদেশে নেই, তা ভারতেকে জানিয়েছে। তারপরও আমি বলব- এগুলো ‘ছদ্মপরিচয়ে’ থাকে। এ বিষয়ে আমরা সচেতন আছি। ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা কোনো তথ্য পেলে আমাদের জানাবে।”
তিনি বলেন, “পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে, ইনটেলিজেন্স শেয়ারিং এর মাধ্যমে, এনফোর্সের মাধ্যমে যেকোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে একমত এবং একাত্ম হয়ে আছি আমরা। যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি।”
সীমান্তে হত্যা শূন্যতে আনতে সম্মতি
সীমান্তে হত্যা বন্ধে আবারও সম্মত হয়েছে দু’দেশ। হত্যা বন্ধে নাগরিকদেরও ‘সচেতন’ করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বৈঠকে।
ড. মো. মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের বলেন, “সীমান্তে ফায়ারিং এবং সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে আমাদের দাবিতে একমত পোষণ করে আন্তরিকভাবে কাজ করবে বলে জানিয়েছে ভারত।”
সচিব বলেন, “সীমান্তে যেন উত্তেজনার সৃষ্টি না হয়, সেজন্য দুই দেশের নাগরিকদের সচেতন ও শিক্ষিত করতে হবে, তারা যাতে করে তাদের সীমান্ত ক্রস না করে। আন্তর্জাতিক নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলে। তাহলে বিএসএফ এবং বিজিবির দায়িত্ব পালন করতে সহজ হবে এবং এ ধরনের কিলিং ইনসিডেন্স আমাদের দেশে ঘটবে না।”
বাংলাদেশ জানিয়েছে, ২০১৫ সালে এ পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ ৩৪ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। ৮ জন ভারতীয় খুন হয়েছে।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে বেসামরিক বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রাণহানি নিয়ে এর আগেও বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও বহুবার সীমান্ত হত্যা বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে। বিএসএফের হাতে প্রাণহানি বন্ধে এই বাহিনীকে ‘প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র’ দেওয়ার কথাও এক সময় বলা হয়েছিল ভারতের পক্ষ থেকে। কিন্তু তবুও থামেনি সীমান্ত হত্যা।
মাদক প্রতিরোধ
বাংলাদেশ মাদক উৎপাদন করে না। ভারতের সীমান্ত দিয়ে এদেশে মাদক ঢুকছে। এই মাদক চোরাচালানের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে মোজাম্মেল হক খান বলেন, “মাদকের বিষয়ে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। বাংলাদেশ কখনই মাদক উৎপাদনকারী দেশ নয়। কিন্তু তারপরও পাচার হয়। ভারত ফেনসিডিল তৈরি করে, এটা তাদের জন্য একটি ড্রাগ। কিন্তু আমরা মনে করি, এটি একটি মাদক। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আমাদের উদ্বেগের বিষয়ে তারা নিজেদের সম্মতি জানিয়েছে এবং আমাদের সঙ্গে একমত হয়েছে।”
নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধ ও বন্দি বিনিময়
বৈঠকে নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধে দুপক্ষই সম্মত হয়েছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্র সচিব বলেন, “শিশু, নারী ও অন্যান্য ট্রাফিকিংয়ের কিছু মামলা আছে, সেগুলো নিয়ে কথা হয়েছে। আমাদের জেলে কিছু ভারতীয় নাগরিক আছেন, তাদের দেশেও আমাদের নাগরিক আছেন। বন্দিদের যাতে তাড়াতাড়ি নিজ দেশে ফিরিয়ে দিতে পারি এবং নিতে পারি সে ব্যাপারে আন্তরিকভাবে আলোচনা হয়েছে। সমুদ্রসীমায় যাতে বিদেশি ট্রলার আসতে না পারে, যেন ট্রাফিকিং এর রুট না হয়- এ ব্যাপারেও আমরা ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।”
বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কী ফিরবেন?
বন্দি বিনিময়ের আওতায় ভারতের শিলংয়ে আটক বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনকে ফেরত আসবে কিনা জানতে চাইলে সচিব মোজাম্মেল হক বলেন, “সুনির্দিষ্ট কোনো নেতা বা ব্যক্তির নাম বলা হয়নি। যারা আছেন, তাদের আনার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।”
অনুপ্রবেশ
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ অনেক সময় সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ছে বলে ভারতকে জানানো হয়। এ বিষয়ে সতর্ক থাকার বিষয়ে একমত পোষণ করেছে দেশটি। স্বরাষ্ট্র সচিব আরো বলেন, “ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমানায় ঢুকে যান, সেগুলো আমরা সুনির্দিষ্টভাবে বলেছি। তারা আমাদের কথা স্বীকার করেছেন এবং তারা সতর্ক অবস্থায় থাকবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।”
‘বৈঠক সফল’
বাংলাদেশ ও ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকটি সফল ও সন্তোষজনক হয়েছে বলে জানান মোজাম্মেল হক খান।
তিনি বলেন, এ বছর ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন হয়েছে। অনুপ চেটিয়াকে আমরা দেশে পাঠিয়েছি, ফেরত এনেছি নুর হোসেনকে (আলোচিত ৭ খুনের আসামি)।
উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তির আলোকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি করে ভারত-বাংলাদেশ। এ চুক্তির আওতায় রাজনৈতিক বন্দিসহ সব ধরনের বন্দি হস্তান্তরের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
বিশ্লেষকরাও বলছেন, দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো জোরদার করতে এ ধরনের বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এখন অত্যন্ত আস্থার সম্পর্ক বিরাজ করছে। অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সম্পর্ক আরো শক্তিশালী করতে এ ধরনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যার ফলাফল ভোগ করছে দুই দেশ।”