পৈচাশিক নির্যাতনে শিশু হত্যা, প্রধান আসামি আটক
2015.07.13

একটি দোকান ঘরের খুঁটির সঙ্গে পিঠ মোড়া দিয়ে দুই হাত বাঁধা। একটি রোলার দিয়ে থেমে থেমে মাথা থেকে পা পর্যন্ত আঘাত চলছে। বাঁধা অবস্থায় যতটা সম্ভব শরীরটাকে বাঁকিয়ে, মাটিতে লুটাতে লুটাতে আর্তনাদ, ‘আমি মরি যাইয়ার! কেউ আমারে বাঁচাও রে বা!’ কিন্তু সে আর্তনাদে গলেনি নির্যাতনকারীদের মন। শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে চলতে থাকে আঘাতের পর আঘাত। আঘাতে আর আর্তনাদে শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছিল। শেষে তার আকুল মিনতি ‘আমারে পানি খাওয়াও!’ কিন্তু বলা হলো ‘পানির বদলা ঘাম খা!’
এটা কোন সিনেমার দৃশ্য নয়। বাংলাদেশের সিলেটে এক কিশোরকে পৈচাশিক নির্যাতনের দৃশ্য, যা নিপীড়করাই মুঠোফোনে ভিডিও বন্দি করেছিল। গত বুধবার সিলেটের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডে চোর অভিযোগে এভাবে নির্যাতনের একপর্যায়ে মৃত্যু হয় শেখ মো. সামিউল আলম রাজন (১৩) নামের ওই শবজি বিক্রেতা কিশোরের।
রাজনকে মেরে ফেলে একটি মাইক্রোবাসে করে লাশ গুম করার চেষ্টা করা হয়। এ সময় নির্যাতনকারী অভিযোগে সিলেট নগরের কুমারগাঁওয়ের শেখপাড়ার বাসিন্দা মুহিত আলমকে (৩৫) আটক করে পুলিশে দেয় এলাকাবাসী।
সিলেট মহানগরের জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আক্তার হোসেন জানান, এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেছে। মামলায় মুহিতসহ তার ভাই কামরুল ইসলাম (২৪), তাদের সহযোগী আলী হায়দার ওরফে আলী (৩৪) ও চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়নাকে (৪৫) আসামি করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চুরির অভিযোগ এনে গত বুধবার সিলেট শহরতলীর কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড এলাকায় শিশু রাজনের ওপর নির্যাতন চালান কামরুল ইসলাম, আলী হায়দার ও ময়না। তাদের নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিও করেন মুহিত। তিনিই প্রথম ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেন।
পৈচাশিকতার প্রমাণ ২৮ মিনিটের ভিডিও
নিপীড়করা চোর ধরে পেটানোর বাহাদুরি দেখাতে রাজনকে নির্যাতনের ঘটনা ভিডিও করে এবং ইন্টারনেটে তা ছড়িয়ে দেয়। ২৮ মিনিটের ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় তোলপাড়।
ভিডিওতে দেখা যায়, গোলাকার লম্বা লাঠি দিয়ে রাজনের হাত-পায়ের নখ ও পেটে আঘাত করা হচ্ছে। এক সময় বাঁ হাত ও ডান পা ধরে মোচড়াতেও দেখা যায়। একপর্যায়ে কাতর হয়ে শিশুটি ক্ষীণ গলায় আর্তনাদ করতে থাকে ‘আমি মরি যাইয়ার! কেউ আমারে বাঁচাও রে বা!’ মারপিটের একপর্যায়ে কয়েক মিনিটের জন্য রাজনের হাতের বাঁধন খুলে রশি লাগিয়ে হাঁটতে দেওয়া হয়। তাকে হাঁটতে দেখে ‘হাড়গোড় তো দেখি সব ঠিক আছে, আরও মারো...’ বলে রাজনের বাঁ হাত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে আরেক দফা পেটানো হয়। ততক্ষণে নির্মম আঘাতে রাজনের শরীর ও চোখ-মুখ ফুলে গেছে !
মার খেতে খেতে দুপা সামনে ছড়িয়ে আর্তনাদ করতে থাকে রাজন। তখন নির্যাতনকারীরা একপা দিয়ে রাজনের হাঁটু চেপে ধরে পায়ের তালুতে লাঠি দিয়ে মারতে থাকে। এভাবে বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে আঘাত করে তারা। নির্যাতনের দৃশ্য যিনি ভিডিও ধারণ করছিলেন, তাকে একপর্যায়ে নির্যাতনকারীদের একজন জিজ্ঞেস করেন, ‘ঠিকমতো ভিডিও ধারণ হচ্ছে কি না।’ ভিডিও ধারণকারী উত্তর দেন, ‘ফেসবুকে ছাড়ি দিছি, অখন সারা দুনিয়ার মানুষ দেখব।’
শেষ দিকে রাজন যখন লুটিয়ে পড়ে তখন নির্যাতনকারীদের একজন সঙ্গীদের কাছে জানতে চান, ‘কিতা করতাম?’ অপর নির্যাতনকারী বলেন, ‘মামায় যে কইছন, ওই কাম করি ছাড়ি দে!’
সৌদি থেকে আটক মূল হত্যাকারী
শুরু থেকেই এলাকাবাসী আশঙ্কা করছিল রাজন হত্যার মূল আসামি কামরুণ ইসলাম দেশ ছেড়ে সৌদি আরব পালিয়ে গেছেন। পুলিশ সে কথা অস্বীকার করে আসছিল। কিন্তু সোমবার সেই কামরুলকে সৌদি আরবের জেদ্দায় আটক করা হয়েছে। স্থানীয় বাংলাদেশীদের সহযোগিতায় তাকে আটক করা সম্ভব হয়েছে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ। তবে কামরুলকে বাংলাদেশে ফেরাতে কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে, যা স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে করতে হবে বলে জানান তিনি।
“এখন সৌদি আরবে অলরেডি ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে, আমরা চেষ্টা করছি, তাকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। তবে মনে হয় না, ঈদের আগে সম্ভব হবে”- বলেন গোলাম মসীহ।
এই নিয়ে এখন পর্যন্ত রাজন হত্যার ঘটনায় চারজন আটক হয়েছেন। এদের মধ্যে লাশ গুম করার সময় হাতে নাতে আটক মুহিতকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। সোমবার ভোরে এ মামলার আরেক আসামি ইসমাঈল হোসেন আবুলকে (৩২) সিলেটের জালালাবাদ থানাধীন লামাকাজি মিরেরগাঁও থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এছাড়া আসামি মুহিতের স্ত্রীও আটক রয়েছেন। অন্য আসামি আলী ও ময়না বর্তমানে পলাতক ।
হত্যাকারীদের ফাঁসি চান রাজনের মা
রাজনের মা লুবনা আক্তার জানান, বুধবার রাতে ছেলে বাড়ি না ফেরায় তারা জালালাবাদ থানায় জিডি করতে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন একটি কিশোরের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। একপর্যায়ে তারা তাদের সন্তানের মৃতদেহ শনাক্ত করেন।
তিনি জানান, স্বামী আজিজুর ভাড়ায় মাইক্রোবাস চালান। কিন্তু যেদিন ভাড়া পান না, সেদিন সংসারের খরচ চালাতে রাজন সবজি বিক্রি করতে বের হত। বুধবার রাজনের বাবা গাড়িতে (ভাড়ার ট্রিপে) ছিলেন বলে বাড়ি ফেরেননি। ওই দিন ভোরে টুকেরবাজার থেকে সবজি নিয়ে বিক্রির জন্য বের হয় রাজন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার পুয়া (ছেলে) চোর না। এই কথা সারা এলাকার মানুষ জানে। (কামরুল) সৌদি আরব থেকে ফিরা অখলতের (বদলোক) চোর ধরার সখ পূরণ করতে গিয়া জীবন দিছে আমার পুয়া! আমি ফাঁসি চাই। উচিত বিচার চাই।”
রাজনের মা বলেন, “পানির লাগি আমার সন্তানে ছটফট করছিলো। মৃত্যুর আগে এক ফুটা পানিও তারে খাওয়াইছে না তারা। অরা কাফির, অরা মুনাফিক। আমার নিরীহ পোলাডারে যেলাখান (যেভাবে) মারছে, আমিও তারা হকলর (সকলের) ফাঁসি চাই। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে সন্তান হত্যার বিচার চাই।”
ছাড়া পাবে না আসামিরা: স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
ঘটনাটি প্রকাশের পর তা নিয়ে দেশজুড়ে তুমুল সমালোচনার মধ্যে সোমবার আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি বলেন, “ঘটনাটি হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী। এ ঘটনায় জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
রাজনের মাথা ও শরীরে ৬৪ আঘাতের চিহ্ন
রাজনের মাথা ও শরীরে মোট ৬৪ টি আঘাতের চিহ্ণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মাথায় পাওয়া আঘাতের ফলে আভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ থেকে তার মৃত্যু হয়েছে বলে সোমবার প্রকাশিত ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সিলেট থানার পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন এর সত্যতা স্বীকার করেন।
ফুঁসছে দেশবাসী
ভিডিও ক্যামেরার সামনে শিশু রাজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় মানুষের ক্ষোভ, ঘৃণা, যন্ত্রণা আর অসহায়ত্বের কথা ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। বিশেষ করে ফেসবুকে গত কয়েকদিন ধরে চলছে প্রতিবাদ ক্ষোভ আর প্রতিবাদের কথা। ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে কেউ কেউ আসামিদেরকেও একইভাবে পিটিয়ে মারার দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছে ঢাকা ও সিলেটের নাগরিকরা।