রাজন হত্যার আসামি কামরুলকে দেশে ফিরিয়ে আনা হল
2015.10.15

অবশেষে দেশে ফিরিয়ে আনা হল সিলেটে কিশোর সামিউল আলম রাজনকে পিটিয়ে হত্যার প্রধান আসামি কামরুল ইসলামকে। বৃহস্পতিবার সৌদি আরব থেকে নিয়ে এসেছে বাংলাদেশের পুলিশ। এবার তাকে রাজন হত্যার বিচারের মুখোমুখি করা হবে।
রাজনকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়া এই বাংলাদেশিকে ফেরত আনতে সৌদি আরবের সঙ্গে আলোচনা চলছিল। সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পর কামরুলকে আনতে গত সোমবার ভোরে রিয়াদে যান পুলিশ সদরের তিন কর্মকর্তা।
সফররত পুলিশের এই দলের সদস্য ও সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ বেনারকে জানান, “বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটার দিকে আসামি কামরুলকে নিয়ে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন তারা। পুলিশের অপর দুই সদস্য হলেন পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত সুপার মাহাবুবুল করিম ও সহকারী পুলিশ কমিশনার এএফএফ নেজাম উদ্দিন”।
‘আলোচনার মাধ্যমেই ফিরিয়ে আনা হয়েছে কামরুলকে’
সৌদি আরবে আটক হওয়ার পর থেকেই কামরুলকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছিল। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি বিনিময় চুক্তি না থাকা। এমন অবস্থায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কামরুলকে ফেরাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সৌদি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানায় এবং শেষ পর্যন্ত আলোচনার মাধ্যমেই তাকে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে পুলিশের আইজি (গণমাধ্যম) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, “সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের কোনো বন্দি বিনিময় চুক্তি না থাকলেও আমরা আলোচনার ভিত্তিতে আসামি কামরুলকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনেছি। আইনগত প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে দেশবাসীর চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে তাকে ফেরত আনা হয়েছে।”
পেছনের ঘটনা
গত ৮ জুলাই সিলেটের কুমারগাঁওয়ে একটি ভ্যান গাড়ি চুরির অভিযোগ তুলে খুঁটিতে বেঁধে ১৩ বছরের কিশোরকে নির্যাতন ও হত্যা করার পর সৌদি আরবে পালিয়ে যান কামরুল। আগে থেকে মধ্যপ্রাচ্যের ওই দেশটিতেই কাজ করতেন তিনি। ছুটিতে দেশে এসে এই নির্মম হত্যাকান্ড ঘটান।
নিপীড়করা চোর ধরে পেটানোর বাহাদুরি দেখাতে রাজনকে নির্যাতনের ঘটনা ভিডিও করে এবং ইন্টারনেটে তা ছড়িয়ে দেয়। ২৮ মিনিটের ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর সারাদেশে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ওই ভিডিওতে রাজনকে নির্যাতনে সবচেয়ে সক্রিয় থাকা কামরুল তখন সৌদিতে পালিয়ে যায়, সেখানে প্রবাসীদের সহায়তায় আটক করে সৌদি পুলিশের হাতে তুলে দেন বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা। এরপর কামরুলকে ফেরাতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ পুলিশ। তার বিরুদ্ধে রেড নোটিসও জারি করা হয়।
এবার বিচারের মুখোমুখি
সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরত এনেই আসামি কামরুলকে সিলেটে নেওয়া হয়েছে। সেখানকার আদালতেই চলছে রাজন হত্যার বিচার। শুক্রবার কামরুলকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হবে। এদিনই ১৬৪ ধারায় কামরুলের জবানবন্দি রেকর্ড করা হতে পারে বলে বেনারকে জানিয়েছে পুলিশের।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এসএম রুকন উদ্দিন বলেন, “কামরুলকে রাতেই সিলেটে এনে কারাগারে পাঠানো হবে এবং পরবর্তী ধার্য তারিখে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।”
আর সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার কামরুল আহসান বলেন, রাজন হত্যার এই প্রধান আসামিকে বিচারের মুখোমুখি করার আগে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া যেতে পারে। এতে কোনো আইনি বাধা নেই।
২৯ জনের জবানবন্দি শুনেছে আদালত
এদিকে সিলেটের আদালতে চলছে আসামি কামরুলকে ছাড়াই শুরু হওয়া রাজন হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম। বুধবার পর্যন্ত এই মামলায় ২৯ জনের জবানবন্দি শুনেছে আদালত। ঘটনার দেড় মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে গত ১৬ অগাস্ট ১৩ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিলেট মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সুরঞ্জিত তালুকদার।
এরপর ২২ সেপ্টেম্বর আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্যে দিয়ে আলোচিত এই হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১ অক্টোবর থেকে শুরু হয় সাক্ষ্য গ্রহণ। কামরুলকে নিয়ে এই মামলার আসামিদের মধ্যে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ।
এআইজি নজরুল বলেন, “রাজন হত্যা মামলার ১৩ আসামির মধ্যে ১১ জন গ্রেফতার হয়েছেন। বাকি দুজনকে আটকের চেষ্টা চলছে।”
পলাতকরা হলেন কামরুলের ভাই সদর উপজেলার শেখপাড়ার বাসিন্দা শামীম আহমদ ও পাভেল আহমদ নামে আরেকজন। তবে কামরুলের আরেক ভাই মুহিত আলম এ মামলায় আটক হয়ে কারাগারে রয়েছেন। পলাতক এই দুই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশিত হয়েছে।
সন্তানের ‘চোর’ অপবাদ থেকে মুক্তি চান রাজনের বাবা
রাজন হত্যার আসা কামরুলকে দেশে ফিরেয়ে আনায় ‘সন্তুষ্টি’ প্রকাশ করেছেন শিশুটির বাবা আজিজুর রহমান।
তিনি বেনারকে বলেন, “সরকার অনেক কষ্ট করে আসামি কামরুলকে দেশে ফেরত নিয়ে এসেছে। আমি সন্তুষ্ট এবং কৃতজ্ঞ। তবে কামরুল এবং তার সহযোগীরা আমার সন্তানকে ভ্যান গাড়ি চুরির অভিযোগে পিটিয়ে মেরেছিল। সে অভিযোগ মিথ্যা তা ইতিমধ্যে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া অনেকের কথায় উঠে এসেছে। কামরুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও আসল সত্য জানা যাবে। আমি চাই আমার মৃত সন্তানকে চোর অপবাদ থেকে মুক্তি দেওয়া হোক”।
এছাড়া কামরুলকে পালাতে সহায়কারীদেরও বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন রাজনের বাবা আজিজুর রহমান।
‘আইনের এই গতি অব্যাহত থাকুক’
রাজন হত্যার চার্জশিট, আসামি গ্রেফতার, প্রধান আসামি কামরুলকে ফিরিয়ে আনাসহ পুরো বিচার প্রক্রিয়ার দ্রুত গতিতে সন্তুষ্ট প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। যেকোন স্পর্শকাতর মামলার বিচারে আইনের এই গতি অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছেন তারা। কামরুলকে দেশে ফেরত আনায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও অনেকেই স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। ধন্যবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশ এবং সৌদি সরকারকে।
এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী সালমা আলী বেনারকে বলেন, “এদেশের পুলিশ ইচ্ছে করলেই আসামিদের বিচারের আওতায় আনতে পারে কামরুলকে ফেরত আনা তারই প্রমান। তবে এখানেই থেমে গেলে চলবে না। বিচার প্রক্রিয়াটি যে গতিতে এগুচ্ছে, সেই গতি অব্যাহত রেখে দোষীদের শাস্তি বিধান করতে হবে। যা যে কোন শিশু নির্যাতনকারীদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে”।
খিজির খান হত্যায় জড়িত দু’জন গ্রেফতার
এদিকে রাজধানীর বাড্ডায় পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ খিজির খানকে গলা কেটে হত্যার পরিকল্পনার হোতাসহ দুজনকে গ্রেফতারের দাবি করেছে পুলিশ।
মঙ্গলবার রাতে পৃথক অভিযানে আলেক বেপারী নামে একজনকে টাঙ্গাইল থেকে এবং তরিকুল ইসলাম তারেক (২৩)নামে অপরজনকে ঢাকার মিরপুর থেকে গ্রেফতার করা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম।
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার মৌলভীপাড়া থেকে গ্রেফতার হওয়া তারেক নিষিদ্ধ সংগঠন জেএমবির নেতা এবং খিজির হত্যাকাণ্ডের হোতা বলে পুলিশের দাবি। ১০ দিন আগে বাড্ডায় খিজির খান হত্যার সময় তারেক উপস্থিত ছিলেন বলেও ধারণা করছে পুলিশ।
গত ৫ অক্টোবর সন্ধ্যার পর বাড্ডা গুদারাঘাট কাইয়ূম কমিশনারের বাড়ির বিপরীতে খিজির খানের মালিকানাধীন বাড়িতে তাকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।