প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য—হিলারির টেলিফোনে বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে!
2015.05.06

পদ্মাসেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করার জন্য সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে বিশ্বব্যাংককে ফোন করিয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পদ্মাসেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক প্রথম যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা ওই সংস্থার নিজস্ব সিদ্ধান্ত ছিল না। মন্তব্য প্রধানমন্ত্রীর।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬ মে প্রকাশ্যে এমন মন্তব্য করার পর ড. ইউনূসকে নিয়ে নতুন আলোচনা–সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। সরকার প্রধানের এমন মনোভাব ও সরকারের কিছু পদক্ষেপে ড. ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশেষায়িত গ্রামীণ ব্যাংক পদে পদে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুর জন্য বরাদ্দ করা তহবিল প্রত্যাহার করে। এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে প্রকল্প সাহায্য ছিল ১৬ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করায় বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণকাজ শুরু করেছে। এতে সরকারের ব্যয় হবে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। পদ্মাসেতুর পরীক্ষামূলক পাইলিং চলছে এবং মূল কাজ শুরুর আগেভাগে প্রধানমন্ত্রী ড. ইউনূস, বিশ্বব্যাংক ও হিলারি ক্লিনটনকে জড়িয়ে এমন মন্তব্য করেন।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের জবাব জানার জন্য বুধবার ইউনূস সেন্টারে যোগাযোগ করা হলে বেনারকে জানানো হয়, তিনি দেশের বাইরে আছেন। তাঁকে (ইউনূস) বিষয়টি জানানো হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্য দেওয়ার পর ৭ মে ড. ইউনূসের সমালোচনা করেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল। সমালোচনাকালে বেশ কয়েকবার মন্ত্রী বলেন, “তিনি (ইউনূস) সম্মানিত ব্যক্তি, আমাদের গর্ব।” এর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করেন।
সমালোচকের তালিকায় যুক্ত হয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেন, “পদ্মাসেতু হলে উনার (ড.ইউনূস) কি ক্ষতি হতো। পদ্মাসেতু প্রকল্পে ঋণ বাতিলের জন্য কেউ না কেউ কলকাঠি নেড়েছেন। কারও না কারও হাত ছিল। সেই জন্য এটি (পদ্মাসেতু) হয়নি। তাই আমি বলব, ইউনূসের উচিত হবে, তার অবস্থান স্পষ্ট করা।”
রাজধানীর শেরে বাংলা নগর-পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলছিলেন আহা মুস্তফা কামাল। ড. ইউনূস প্রসঙ্গে মন্ত্রী আরও বলেন, দেশে একটি ভালো কিছু হলে তিনি এগিয়ে আসেন না কেন?
“ড. ইউনূস আমাদের শ্রদ্ধেয়। তিনি কতটা ভালো করেছেন কতটা খারাপ করেছেন এটা দেশের মানুষ জানে। তার কাছ থেকে যারা ঋণ গ্রহীতা আছেন তারা জানেন ড. ইউনূস কতটা ভালো। আমি বলতে পারব না। কারণ আমি তার কাছ থেকে ঋণ নেইনি,” জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।
এর ঠিক একদিন আগেই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় ড. ইউনূসের সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের ৫৪টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ঋণের ফাঁদে আটকে আছে।
এ সময় তিনি আরও বলেন, ১৯৯৬ সালে মুঠোফোনের লাইসেন্স দেওয়ার দরপত্রে গ্রামীণ ফোনের অবস্থান ছিল চতুর্থ। শুধু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সুবিধা পাবে-এ উদ্দেশ্যে গ্রামীণ ফোনকে লাইসেন্স অনুমোদন দেওয়া হয়। এ জন্য তখন সমালোচনা হয়েছে। কথা ছিল প্রতিষ্ঠানটি যৌথ বিনিয়োগে হবে। কিন্তু ড. ইউনূস শেয়ার বিক্রি করে দেন।
এদিকে সরকারের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) নিমগাছি সামাজিক মৎস্য চাষ প্রকল্পে গ্রামীণ ব্যাংকের অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য জানতে পেরেছে। প্রকল্প নজরদারিকারী প্রতিষ্ঠান আইএমইডির এক প্রতিবেদন বলছে, স্থানীয়দের দারিদ্র্যবিমোচনে ৮০০ পুকুর নামমাত্র মূল্যে ইজারা নিয়ে উচ্চ সুদে ঋণ দিয়েছে ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ মৎস্য ও পশু সম্পদ ফাউন্ডেশন।
তবে এ প্রসঙ্গে গ্রামীণ সেন্টারের একটি সূত্র জানায়, প্রায় পাঁচ বছর আগে শেষ হওয়া প্রকল্প এখন তদন্ত করে দুর্নীতির অভিযোগ তোলাটা উদ্দেশ্যমূলক। মূলত ড. ইউনূসকে ঘায়েল করতে একের পর এক এমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
এর আগে উচ্চ আদালতে গেছে গ্রামীণ ব্যাংকের নয়জন পরিচালকের পদ শূন্য ঘোষণার বিষয়টি। গত ২৯ এপ্রিল একটি রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের নির্বাচিত নয়জন পরিচালকের পদ শূন্য ঘোষণা করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চান হাইকোর্ট।
গত ৩০ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয় গ্রামীণ ব্যাংকের নয়জন নির্বাচিত পরিচালকের পদ শূন্য ঘোষণা করে চিঠি দেয়। চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁদের মেয়াদ শেষ হয়। ওই চিঠির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ব্যাংকের পরিচালক তাহসিনা খাতুন।
প্রায় ৯০ লাখ গ্রাহকের গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে বয়সের কথা বলে এর প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সরিয়ে দেয় সরকার। এ নিয়ে দেশে ও বিদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। ড. ইউনূসের পর ব্যাংকটির নেতৃত্ব নিয়ে অচলাবস্থা চলছে।
সম্প্রতি নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনূসের দানের অর্থ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড–এনবিআর। এ বিষয়ে তিনি ছয় মাসের জন্য উচ্চ আদালতের সুরক্ষা পান গত ২ এপ্রিল থেকে।
এনবিআর দাবি করে, ২০১১-১২ থেকে তিনটি করবর্ষে জমা দেওয়া বার্ষিক আয়কর বিবরণীতে প্রদর্শিত দানের অর্থের ওপর ইউনূস কর দেননি।
এই সময়ে তিনি ৭৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা দান করেছেন। কিন্তু এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, দান কর বাবদ ১৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা জমা করেননি ইউনূস।
“তিনি (ড. ইউনূস) বিপুল অর্থ প্রবাসী আয় হিসেবে দেশে এনেছেন, যা করমুক্ত। আর যে টাকা তিনি দান করেছেন, তাতে কর অব্যাহতি দেওয়া রয়েছে,” বেনরাকে জানান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কর পরামর্শক মাহবুবুর রহমান ।
“এর আগে ড. ইউনূসকে নিয়ে এর আগে প্রধানমন্ত্রী সমালোচনা করলেও তা রাখঢাক পর্যায়ে ছিল। কিন্তু ৬ এপ্রিলের সমালোচনা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, সামনে আরও কঠোর সমালোচনা ও সরকারের পদক্ষেপ অপেক্ষা করছে ওই নোবেলজয়ীর জন্য,” বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনসুর মূসা।
ওই শিক্ষকের মতে, ড. ইউনূসকে ব্যঙ্গ করার জন্যই বছরখানেক আগে তাকে বিশ্বব্যাংকের প্রধান করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট প্রতিনিধি দলকে প্রধানমন্ত্রী এমন আহ্বান জানানোর ঘটনা তখন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।
“সাধারণত আমেরিকা থেকেই বেশির ভাগ বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রধানমন্ত্রী এটা জেনেও ড. ইউনূসকে নিয়ে এ ধরনের বক্তব্য দেন,” জানান মনসুর মূসা।
৬ মে ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণের কঠোর সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। এই ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান ইউনূস।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬ মে নিজের লেখা ‘ওরা টোকাই কেন’ বইয়ের উদাহরণ টেনে বলেন, ‘আমার এই বইয়ে জুলেখা নামের একটি গ্রাম্য মেয়ের চরিত্র রয়েছে। তার বাড়ি আমার এলাকায়।’
“আমি খুব শখ করে জুলেখাকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিতে বলেছিলাম। এরপর জুলেখা পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নেয়। এর কিছু দিন পর সে আমার কাছে এসে কান্নাকাটি করে। সে বলে, তাকে (জুলেখা) পাঁচ হাজার টাকা ঋণের জন্য ১৬ হাজার টাকা ফেরত দিতে বলা হয়েছে,” জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, “এ বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তোলে। পরে ওই বই লেখার সম্মানী থেকে আমি জুলেখার ঋণ পরিশোধ করি।”
ফিণল্যান্ডের হেলসিংকীতে অবস্থানরত বাঙালি এবং একটি রেস্টুরেন্ট মালিক মনির হোসেন টেলিফোনে ড. ইউনূসকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাবের সমালোচনা করেন।
“দেশে যে, যাই বলুক বিশ্বের অনেক দেশে এখন বাংলাদেশকে চেনা হয় নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের দেশ হিসেবে। তাঁকে শত্রু না ভেবে দেশের সম্পদ ভাবা উচিত,” টেলিফোনে বেনারকে জানান মনির হোসেন।