হাওয়ায় ভাসছে আনসারুল্লাহর উড়ো চিঠি আর দায় স্বীকার
2015.07.14

চাপাতির আক্রমনে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে একের পর এক ব্লগার হত্যায় জড়িত যে দলটিকে সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামের ইসলামি সংগঠনটির অস্তিত্ব বিরাজ করে কিনা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তার কোনো জোরালো প্রমাণ হাজির করতে পারে নাই।
এ বছরের গোড়ার দিকে পৃথক পৃথক আক্রমনে ৩ ব্লগারকে হত্যা করার পর এবিটি’র নামে একটা হিট-লিস্ট গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। পুলিশ এপর্যন্ত ৩০ জনের মতো আনসারুল্লাহর সদস্যকে গ্রেফতার করে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করেছে। কিন্তু সেই সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা তাদেরকে কোন প্রশ্ন করার সুযোগ পায়নি।
সাবেক কূটনীতিক ও কলাম লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ যিনি নিয়মিত জঙ্গিদের নিয়ে লেখালেখি করে আসছেন, বেনার নিউজকে বলেন, “ আমি জানিনা পুলিশ এইসব খ্যাতনামা ব্লগারদের হত্যায় এবিটি’র জড়িত থাকার ব্যাপারে জোরালো তথ্য দিতে পারছে না কেনো। সন্দেহভাজন হিসেবে যাদেরকে পুলিশ মিডিয়ার সামনে এনে দাঁড় করাচ্ছে তাদের সাথে সাংবাদিকদের কোনো কথা বলার সুযোগ না দেয়ায় বিষয়টি প্রশ্ন-বিদ্ধ হচ্ছে’।
তিনি বলেন, “এতে মনে হচ্ছে কোনো শক্ত প্রামাণ ছাড়া এদেরকে সামনে এনে পুলিশ আসল অপরাধী বের করার ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা লুকানোর চেষ্টা করেছে”।
আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নামটা প্রথম শোনা যায় ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যার অভিযোগে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির ৬ জন ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করার সময়। মিরপুরে নিজের বাসার সামনে নাস্তিকতার দায় চাপিয়ে চাপাতির আক্রমন চালিয়ে তারা রাজীবকে হত্যা করে।
এবিটি পরবর্তিতে ভিন্ন ভিন্ন নামেও পরিচিতি পায়, যেমন আনসার বাংলা-৭, আনসার বাংলা-১৩ ইত্যাদি।
পুলিশ কথিত আধ্যাত্নিক নেতা মুফতি জসিমউদ্দিন রহমানীকে ২০১৩ সালের আগষ্টে আটক করে। রাজীব হত্যায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ তাকে সহ ৬ ছাত্রের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করে। কিন্তু এরপর শুনানীর কোনো দিন-ক্ষণ ধার্য করা হয় নাই।
এই চার্জশীট দেয়া হয় পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী আটককৃতদের জিজ্ঞাশাবাদকালে ঘটনায় জড়িত থাকার ব্যাপারে তাদের স্বীকারোক্তির উপর ভিত্তি করে।
ধীরগতিতে চলছে আইনী প্রক্রিয়া
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো সামনে এগুচ্ছে না। জঙ্গি-সম্পর্কিত মামলাগুলো এগিয়ে নিতে খোদ সরকারই আগ্রহী না বলে তারা মনে করেন। সরকার মামলাগুলোর নিষ্পত্তি চায় না।
জঙ্গিবাদী মামলায় অভিজ্ঞ আইনজীবি ফারুক আহমেদ বেনারকে বলেন, “একবার তাদেরকে জেলে ঢোকানোর পর তাদের ব্যাপারে আর আগ্রহী হয় না, শুধু বছরের পর বছর জেলে ফেলে রাখা হয়”।
তারমতে, “ যেকোনো অপরাধীর আইনী সহায়তা পাবার অধিকার আছে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবার সুযোগ আছে, কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে এসব জঙ্গি সম্পর্কিত মামলা নিতে কেউ আগ্রহী নয়। এতেই বোঝা যায়, আইনজীবিরা কেনো এইসব মামলা নিতে আগ্রহী না”।
অভিজিৎ, ওয়াশিকুর রহমান ও অনন্ত বিজয় দাশ এই তিনজন ব্লগারকে হত্যার পর র্যাব এটিবি সন্দেহে এ পর্যন্ত ৩০ জনকে আটক করেছে।
গতমাসে এবিটি ২৫ জন গণ্যমান্য লেখক-শিক্ষক ও সুধীদের তালিকা করে হত্যার হুমকি দেয়।তাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকীর নামও রয়েছে।
তাদের সঙ্গে অন্যান্য ব্লগারদের হত্যার হুমকি ছাড়াও এপ্রিলে একটি দুর্ধর্ষ ব্যাংক ডাকাতির সময় ৮ জনকে হত্যা করার ঘটনার পর সরকার দ্রুত আনুষ্ঠানিকভাবে এবিটি নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেয় গত ২৫ মে।
খুঁজে পাওয়া কঠিন
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, এবিটিকে খুঁজে বের করা মুশকিল কারণ এর কোনো সাংগঠনিক কাঠামো নেই। অন্যান্য ইসলামিক গ্রুপ যেমন জামাতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও হরকত-উল-জিহাদ আল ইসলামী (হুজি)এর মতো কাঠামো এদের নেই। সরকার এগুলোকে আগেই নিষিদ্ধ করেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের জয়েন্ট কমিশনার মনিরুল ইসলাম বেনার নিউজকে বলেন, “এদের কার্যক্রম শুধু মাত্র লিফলেট বিতরন ও সোশাল মিডিয়ায় বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর এ কারণেই তাদেরকে ধরা খুব কঠিন”।
যখন তাকে প্রশ্ন করা হয়, আপনারা কেনো গ্রেফতারকৃতদের সাথে কথা বলে তাদের অপরাধের সাথে যুক্ত থাকার ব্যাপারে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকদের অনুসন্ধানের সুযোগ দিচ্ছেন না? জবাবে তিনি বলেন, “আটক থাকা অবস্থায় অপরাধীদের সাথে সাংবাদিকদের কথা বলা আইনসঙ্গত নয়, এ ব্যাপারে হাইকোর্টের রুলিং আছে”।
জনগনের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর জন্য
তবে, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা মনিরুলের বক্তব্যকে মানতে রাজী নন। প্রশ্ন তোলেন, যদি সাংবাদিকরা জঙ্গিদের সাথে কথা বলার সুযোগ না পায় তাহলে আটক সন্দেহভাজনদের আদালতে সোপর্দ করে বিচার শুরু করতে বাঁধা কোথায়?
নাগরিক উদ্যোগ-এর সমন্বয়কারী শরিফুজ্জামান শরীফ বেনারকে বলেন, “ আন্তর্জাতিক মহলের বাহবা কুড়ানো এবং দূর্নীতি ও আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতির ইস্যু থেকে জনগনের দৃষ্টি ভিন্নদিকে সরানোর জন্য পুরো ব্যাপারটাই সাজানো বলে মনে হচ্ছে”।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এই দুইদেশই বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্তপুর্ণ। উগ্রপন্থিদের ব্যাপারে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে খুব খুশি বলে মনে হয়।
পালিয়ে বেড়াচ্ছে জঙ্গিরা
কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, এবিটির অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দেহ থাকা সত্তেও শেখ হাসিনার সরকারের তৎপরতায় সাধারনভাবে জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিতে পারছে না, এ জন্য শেখ হাসিনা কৃতিত্বের দাবি রাখে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) আব্দুর রশীদ বেনারকে বলেন, “তারা পরিস্কার ভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, জাতীয় নিরাপত্তার জন্য যেকোনো সময় গুরুতর হুমকি হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে জঙ্গিরা মূলত এখন দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়”।
তিনি আরো বলেন, এতে আত্নতৃপ্তির কোনো সুযোগ নেই এবং “ আমাদের নির্লিপ্ত থাকলে চলবে না, যেকোনো রাজনৈতিক দুর্যোগে এরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, দূর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে তা অস্বাভাবিক নয়”।