বাংলাদেশে এসিড সন্ত্রাস কমেছে
2016.03.07

২০০২ সালে চারশ ৯৬ জন হলেও ২০১৫ সালে ৭৪ জনে নেমেছে, বাংলাদেশে এসিড আক্রান্তদের সংখ্যা। বেসরকারি সংস্থা এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের এই পরিসংখ্যান বলছে, এদেশে এসিড সন্ত্রাসের ঘটনা কমছে। তবে তা আজও একেবারে নির্মূল করা যায়নি।
কঠোর আইন, এসিড ক্রয়-বিক্রয়ের বাধ্যতামূলক লাইসেন্স থাকার বিধান, ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির কারণেই মূলত এসিড সন্ত্রাস কমে আসছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ভয়ঙ্কর এই সন্ত্রাস একেবারেই নির্মূল না হওয়ায় কিছুটা উদ্বিগ্নতাও প্রকাশ করেছেন তারা।
এদিকে সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় বাংলাদেশের এসিড আক্রান্ত মানুষগুলো ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। কেউ কেউ আবার সামাজিক নানা কাজে যুক্ত হয়ে সমাজ বদলাতে ভূমিকাও রাখছেন।
কঠোর আইনে কমেছে এসিড অপরাধ
কয়েকবছর আগেও দেশে যেভাবে এসিড সন্ত্রাসের কথা শোনা যেত, এখন সেটা অনেকটাই কমে এসেছে। এর অন্যতম কারণ, এসিড অপরাধ দমনে কঠোর আইন প্রণয়ন।– বলছিলেন, সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ থানার একজন এনজিও কর্মী।
তার কথার সত্যতা মেলে এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যানে। এতে দেখা যায়, ২০০৩ সালে সারাদেশে চারশ ৯৪টি এসিড সন্ত্রাসের ঘটনায় আক্রান্ত হন ৪৯৬ জন। পরের বছর ৩২৬টি ঘটনায় আক্রান্ত হন ৩৩৩ জন। এভাবে ২০০৫ সালে ২৭৭ জন, ২০০৬ সালে ২২৪ জন, ২০০৭ সালে ১৯৯জন , ২০০৮ সালে ১৮৪ জন, ২০০৯ সালে ১৫৯ জন, পরের বছর ১৬০ জন, ২০১১ সালে ১১৮ জন, ২০১২ সালে ৯৮ জন, ২০১৩ সালে ৮৬ জন, ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে ৭৪ জন করে এসিড আক্রান্তের শিকার হন। এছাড়া নতুন বছরে প্রথম দুমাসে ৮জন এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন বলেও জানা যায়।
এ বিষয়ে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বেনারকে বলেন, নিঃসন্দেহে দেশে এসিড-সন্ত্রাস কমে এসেছে। যেখানে ২০০১ সালে সারাদেশে বছরে চার শতাধিক এসিড-হামলার ঘটনা ঘটত, সেই সংখ্যা এখন ৭০-এ নেমে এসেছে। তা সম্ভব হয়েছে সরকারি-বেসরকারি ও সামাজিক প্রচেষ্টার ফলেই।
তবে শুধু নারী ও শিশুরাই অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার নন, এ তালিকায় নানা বয়সের পুরুষও রয়েছেন। এএসএফের তথ্যমতে, ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ৩ হাজার ৬৬০ জন। ২০১৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৫৩৩ জন। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৮৫১ জন নারী, ৮৭৭ জন শিশু আর পুরুষের সংখ্যা ৯০৫ জন।
পরিসংখ্যান বলছে, বিভিন্ন বয়সী নারী, শিশু ও পুরুষরা এসিড আক্রান্তের শিকার হলেও ১৯ থেকে ৩৫ বছর বয়সী নারী ও পুরুষরাই বেশি এই ভয়াবহতার শিকার হচ্ছেন। গবেষণা বলছে, প্রেম প্রত্যাখ্যান, যৌতুক, পারিবারিক বিরোধ, বৈবাহিক সমস্যা ও জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের কারণেই এসব বয়সের মানুষ বেশি এসিড সন্ত্রাসের শিকার হন।
সমাজের মূল ধারায় এসিড আক্রান্তরা
তবে শরীর পুরে গেলেও এসিড সন্ত্রাসের শিকার মানুষগুলোর আত্মবিশ্বাস টলেনি। শারীরিক ক্ষত নিয়েই তারা সমাজের ক্ষত সারাচ্ছেন। সরকারি বেসরকারি নানা সহযোগিতায় তারা ফিরছেন সমাজের মূল ধারায়।
তাদেরই একজন বগুড়ার জুলেখা বেগম। বছর দশেক আগে তিনি দুর্বৃত্তদের এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হন। ঢাকার এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে তিনি জানান, সেই মুহুর্তে আমার কাছে বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর ছিল। তবে সময় পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে জীবনের মোড় বদলেছে। এখন আমি নিজেই এসিডদগ্ধদের পাশে দাঁড়াই। তাদেরকে নতুন করে বাঁচার প্রেরণা যোগাই।”
সিরাজগঞ্জের এসিড আক্রান্ত মানেজাও জানান তিনি নানা ধরনের সামাজিক কাজে যুক্ত। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধসহ নিজ এলাকার ছোটখাটো সামাজিক বিরোধও নিষ্পত্তি করেন মানেজা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে যেন আর একজন মানুষও আর এসিড-সন্ত্রাসের শিকার না হয়।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, এসিড আক্রান্তদের সমাজের বোঝা ভাবলে চলবে না। তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে আইনগত, কাউন্সেলিং, চিকিৎসা দিতে হবে। তা একা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। দিতে হবে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতা। এ বিষয়ে সরকার, সমাজ ও পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে।
এছাড়া দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুসারে এসিড আক্রান্তদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান শাহীন আনাম।
সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর হয়নি একটিও
এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এসিড সন্ত্রাসের ঘটনায় সারাদেশে মোট দুই হাজার ১৯টি মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৮৫ টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পেয়েছেন ৩২৫ জন। যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছেন ১১৭জন। আর ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছে। তবে এসব মৃত্যুদন্ডের একটিও এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মৃত্যুদন্ড কার্যকর না হওয়া এসিড নিক্ষেপের ঘটনা নির্মূল না হওয়ার অন্যতম কারণ।
এ বিষয়ে এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সেলিনা আহমেদ বেনারকে বলেন, অবশ্যই এসিড সন্ত্রাস কমেছে। এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান, সরকার, বেসরকারী জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম, দেশের তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ, এসিড ক্রয়-বিক্রয়ের বাধ্যতামূলক লাইসেন্স থাকার বিধান, যত্রতত্র এসিড বিক্রি বন্ধ হওয়াসহ বিভিন্ন প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমের কারণেই কমে এসেছে এসিড সন্ত্রাস।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এ অপরাধের বিচার ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির কথা বলা থাকলেও মামলাগুলো দীর্ঘসূত্রিতায় পড়ছে। এখন পর্যন্ত ১৪জনকে মৃত্যুদন্ডের রায় দেওয়া হলেও একটিও কার্যকর করা হয়নি। সমাজে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেখাতে না পারলে এ অপরাধ আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে বাধ্য। এছাড়াও এসিড ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কঠোর পর্যবেক্ষণের প্রতিও গুরুত্ব দেন তিনি।
এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এসিড-সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। যদি অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে থাকে, তাহলে কখনোই এটা চিরতরে নির্মূল করা সম্ভব হবে না।
ফাঁসি কার্যকরের আশ্বাস মন্ত্রীর
এ বিষয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বেনারকে বলেন, আমি শুনেছি এখন পর্যন্ত এসিড-হামলার ঘটনায় ১৪টি ফাঁসির রায় হয়েছে, যার একটিও এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। এসব রায় কার্যকরে কেন সময় লাগছে সে বিষযয়ে আমি খোঁজ নেব।
তবে এসিড সন্ত্রাস কমে আসায় সন্তোষ প্রকাশ করে প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, এটি সমাজের ইতিবাচক দিক। তবে সমাজ থেকে এই ভয়ঙ্কর অপরাধ নির্মুল করতে হবে।
এসিড আক্রান্তদের উন্নয়নে সমাজের সকলকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ারও আহবান জানান তিনি।