গড় আয়ু বেড়ে ৭০ বছর, চাপ মোকাবিলার প্রস্তুতি নেই
2015.04.20

শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল বেড়ে ৭০ বছর ১ মাসে উন্নীত হয়েছে। এর পাশাপাশি পাঁচ বছরের নিচে বিভিন্ন বয়সী শিশুর মৃত্যুহার ধারাবাহিকভাবে কমছে।
সর্বশেষ আদমশুমারিকে ভিত্তি করে পরবর্তী বছরগুলোতে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে তৈরি করা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়বে। কিন্তু এঁদের জন্য যে ধরণের সেবার দরকার হবে, তা সামাল দেওয়ার মতো স্বাস্থ্যসহ অনান্য সেবা খাত তৈরি হয়নি।
“গড় আয়ু বাড়ার প্রাথমিক কারণ মৃত্যুর হার কমে আসা। দেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ এবং জন সচেতনার কারনে শিশু এবং বয়স্ক উভয় স্তরে মৃত্যুহার কমেছে,” বেনারকে জানান জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ এ কে এম নূর-উন-নবী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক, বর্তমানে রংপুরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।
দেশে প্রতি ১০ বছর অন্তর আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। শুমারি পরবর্তী বছরভিত্তিক জনসংখ্যা ও জনতাত্ত্বিক সূচকসমূহের পরিবর্তন হতে থাকে। তাই এই প্রকল্পের মাধ্যমে জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, তালাক, আগমন, বহির্গমন এবং আর্থ-সামাজিক তথ্য সংগ্রহ করে হালনাগাদ করা হয়।
“এবারের প্রতিবেদনটি ২০১৩ সাল জুড়ে তথ্য সংগ্রহ করে চূড়ান্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহের আওতা আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে,” প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে বেনারকে বলেন প্রকল্প পরিচালক একেএম আশরাফুল হক।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে এদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩৯.৯৩। ১৯৮০ সালে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫.২৪। ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের গড় আয়ু ছিল ৬০ বছর। ২০১১ সালে মানুষের গড় আয়ু দাঁড়িয়েছে সত্তরের নীচে, এখন তা সত্তরের কিছুটা বেশি।
বিবিএসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের ১৫ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে রয়েছে মোট জনগোষ্ঠীর ৫৩ দশমিক ৭ শতাংশ। ১৫ বছরের নিচে রয়েছে ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী। যা তার আগের বছরে ছিল যথাক্রমে ৫৩ দশমিক ৯ ও ৩১ দশমিক ১ শতাংশ।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃদ্ধ হওয়ার বয়স যে ৬০ বছর, বাংলাদেশের চিরাচরিত সেই ধারনা পাল্টে যাচ্ছে। এদেশের সমাজ ব্যবস্থায় ৬০ বছরের কিছু আগে বা পরে মৃত্যুর হিসাব কষা হয় বেশ জোরেসোরে। কিন্তু প্রবীণ মানুষদের কেউবা শ্রম দিচ্ছেন, কেউ কেউ মেধা খাটাচ্ছেন।
ঢাকার অদূরে মহাসড়কের কাছে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গাছ কাটছিলেন নুরুল সিকদার (৭২) । তাঁকে দেখে এত বয়স মনে হয়না। এর কারণ জানতে চাইলে বেনারকে তিনি বলেন, “জীবনভর গ্রামের শাক-সবজি আর পদ্মার মাছ খাইছি। বয়স আমারে ধরতে পারে নাই।”
পাঁচ সন্তানের পিতা নুরুল সিকদারের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার দক্ষিণ মান্দ্রা গ্রামে। পেশা জানতে চাইলে হেসে বলেন, “আমিতো একেক সময় একেক কাম করি। কহনও পদ্মায় মাছ ধরি, কহনও ধানি জমিতে কাম করি। আবার বড় পোলা বিল্লালকে নিয়া গাছের কামও করি।”
বাংলাদেশে গড় আয়ু বাড়ার কারন হিসেবে মৃত্যুহার কমা ছাড়াও আরও কিছু বিষয় নেপথ্যে কাজ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এদেশের মানুষ এখন পুষ্টিকর খাবার খেতে পারে, মানুষের খাদ্যাভাসে পরিবর্তন এসেছে, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা (সোশাল সেফটিনেট) কর্মসূচীর সুফল পাচ্ছে দরিদ্র মানুষেরা।
এছাড়া রেমিটেন্স বেড়েছে, নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন উভয়ই বেড়েছে। সর্বোপরি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মক্ষেত্রসহ সরকারি-বেসরকারি সব ধরণের উদ্যোগ বা কর্মকাণ্ডে মানুষের প্রবেশ অধিকার (অ্যাকসেস) এবং সুযোগ-সুবিধা (ফ্যাসিলিটিজ) ক্রামন্বয়ে বাড়ছে।
চিকিৎসকেরা বলছেন, বাংলাদেশ এখন বিভিন্ন রোগব্যাধি জয় করেছে। ডায়রিয়া বা কলেরায় মৃত্যুর হার কম। ‘যক্ষা হলে রক্ষা নেই’ বলে যে আতংক ছিল, তাও কেটে গেছে, এটা এখন নিরাময়যোগ্য রোগ। ম্যালেরিয়া, কুষ্ঠ রোগেও মৃত্যুর হার কমে এসেছে।
“বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ চিকিৎসা সুবিধা অনেকটা সহজলভ্য হওয়া। তাছাড়া শহরের পাশাপাশি গ্রামের মানুষও এখন স্বাস্থ্য সচেতন,” বেনারকে জানান রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের অধ্যাপক অনুপ কুমার সাহা।
ডা. অনুপ বলেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় নানা অসঙ্গতি ও দুর্বলতা আছে, তারপরও সামগ্রিক অগ্রগতি অবহেলা করার মত নয় এবং গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অগ্রগতি।
বিবিএসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে শিশুমৃত্যু হার হ্রাসে। নবজাতক থেকে বিভিন্ন বয়সের শিশুমৃত্যুর হার কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
১৯৯০ সালে বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ১৫১ টি শিশু মারা যেত। ২০০৯ সালে ৫ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুহার ছিল হাজারে ৫০ জন। পরবর্তী বছরগুলোতে যথাক্রমে এ সংখ্যা কমে এসেছে ৪৭, ৪৪, ৪২ ও ২০১৩ সালে ৪১ জনে।
এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, এদেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচী (ইপিআই) অভূতপূর্ব সফল হয়েছে। ডায়রিয়ার কারনে মৃত্যুহার এখন খুবই কম।
আরো যেসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি: দেশের মানুষের পানি ব্যবহারের হার (ট্যাপ ও নলকূপ) ২০০৯ সালে ৯৮ দশমিক ১ শতাংশ ছিল; যা পরবর্তী বছরে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৩ সালে ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে।
বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহারের উন্নতি হয়েছে। ২০০৯ সালে দেশের ৬২ দশমিক ৭ শতাংশ এ সুবিধায় ছিল, ২০১৩ সালে এ হার হয়েছে ৬৪ দশমিক ২ শতাংশ। তবে এখনও আড়াই শতাংশ মানুষ উন্মুক্ত স্থানে মল-মূত্র ত্যাগ করে।
এদিকে বিভিন্ন কারণে গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সরকার ‘দি পাবলিক সার্ভিস (রিটায়ারমেন্ট) এ্যাক্ট, ১৯৭৪ সংশোধন করে চাকরি থেকে অবসরের বয়স ৫৭ থেকে ৫৯ বছর নির্ধারন করেছে। ওই বয়সে কর্মক্ষম থাকার বিষয়টি যুক্তি হিসেবে তুলে ধরে এই সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর ফলে দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা দু বছর বেশি চাকরি করার সুবিধা পাচ্ছেন।
“এখন দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সের মানুষ প্রায় সাড়ে ছয় শতাংশ। ২০৫০ সালে এটা ২০ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। এই চাপ অর্থনীতি কিভাবে মোকাবিলা করবে, সেটি বড় প্রশ্ন। তখন বয়স্কদের বোঝা মনে হতে পারে,” বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ভবিষ্যৎ প্রভাব সম্পর্কে এই মত দিলেন এ কে এম নূর-উন-নবী।