পণ্য পরিবহনে যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞায় নড়েচড়ে বসেছে সরকার

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.03.10
BD-airport যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তারা বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় ধারাবাহিকভাবে বড় ধরনের ঘাটতি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
ফোকাস বাংলা

নিরাপত্তায় ঘাটতি থাকার অভিযোগে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহনে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাজ্য। গত বছরের নভেম্বর থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে অস্ট্রেলিয়া।

নতুন করে যুক্তরাজ্যের এই পদক্ষেপ ইউরোপের অন্যান্য দেশে রপ্তানির ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ। রপ্তারিকারকেরা মনে করছেন, এই নিষেধাজ্ঞার ফলে রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষতি হবে।

সরকারি হিসেবে, ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে যুক্তরাজ্যে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের পোশাকপণ্য রপ্তানি করা হয়েছে, যা ওই বছরের মোট পোশাক রপ্তানির ১১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। ওই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

চলতি ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই থেকে জানুয়ারি) ২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হয়, যা মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ১৪ দশমিক ৪২ শতাংশ।

গত মঙ্গলবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেওয়া এক চিঠিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন।

যুক্তরাজ্যের এই সিদ্ধান্তের পর নড়েচড়ে বসেছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। গতকাল বৃহস্পতিবার জরুরি সভা ডেকে বিমানবন্দরে অফিস করার ঘোষণা দিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ও মন্ত্রণালয়ের সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরী।

ব্রিটিশ সরকার জানিয়েছে, ৩১ মার্চের মধ্যে দুই দেশের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী নিরাপত্তা জোরদারের কাজ শুরু না হলে বাংলাদেশ বিমানের যুক্তরাজ্যগামী সরাসরি যাত্রীবাহী ফ্লাইটও নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়তে পারে।

“বিমান বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়নে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের সম্মত কর্মপরিকল্পনাকে আরও ত্বরান্বিত করতে ৩১ মার্চ পর্যন্ত দিনের একটি সময়ে আমি ও সচিব বিমানবন্দরে অফিস করব,” বেনারকে জানান রাশেদ খান মেনন।

মন্ত্রী বলেন, “যুক্তরাজ্যের পরিবহনমন্ত্রী প্যাট্রিক ম্যাকলাউলিন গত মঙ্গলবার ফোনে এ নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজ শুরুর তাগিদ দিয়েছেন।”

যুক্তরাজ্যের সরকারি ওয়েবসাইটে গত মঙ্গলবার সরাসরি পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞার খবরটি প্রকাশ করা হয়। ‘বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট আপডেট’ শীর্ষক ওই ঘোষণায় যুক্তরাজ্য বলেছে, বিমানবন্দরটির সাম্প্রতিক মূল্যায়নে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু শর্ত পূরণ হয়নি।

পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষে যুক্তরাজ্যের বিমান নিরাপত্তা-বিষয়ক দপ্তর বিশ্বের ২০টি দেশের নিরাপত্তাঝুঁকিতে থাকা ৩৮টি বিমানবন্দরের যে তালিকা তৈরি করেছে, তাতে শাহজালাল বিমানবন্দরের নাম রয়েছে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পাশ্চাত্যের কয়েকটি দেশের পক্ষে যুক্তরাজ্যকে বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দরের নিরাপত্তা মূল্যায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত কয়েকমাসে ঢাকায় কয়েক দফা সফর এবং বিমানবন্দরের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করেছেন যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মকর্তারা।


নিষেধাজ্ঞা অনাকাঙ্ক্ষিত: মন্ত্রণালয়

নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর গতকাল মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যুক্তরাজ্যের ঢাকাস্থ হাইকমিশন, অ্যাভিয়েশন টিম এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে বিমান বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হচ্ছে। এ ছাড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার আধুনিকায়নে বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, আধুনিক সরঞ্জামাদি সংগ্রহে গত ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একনেকের সভায় ৯০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়েছে। বাংলাদেশের গৃহীত ব্যবস্থাদি সন্তোষজনক বলে এর আগে ব্রিটিশ হাইকমিশন জানিয়েছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের সাময়িক নিষেধাজ্ঞা অনাকাঙ্ক্ষিত বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।।

গতকাল অনুষ্ঠিত মন্ত্রণালয়ের বৈঠক সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিমান বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং ব্যবস্থার উন্নয়নে সিভিল অ্যাভিয়েশন ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস আরও নিবিড়ভাবে কাজ করবে এবং মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পুরো কর্মকাণ্ড নজরদারি করা হবে।

মন্ত্রণালয়ের আশাবাদ হচ্ছে, “দুই পক্ষের গৃহীত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দ্রুত যুক্তরাজ্যের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবে এবং দুই দেশের সম্পর্ক আরও উষ্ণ ও গভীর হবে।”

গত অক্টোবরে পেতে রাখা বোমায় মিসরের সিনাই উপত্যকায় রাশিয়ার একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। এরপর বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদারের তাগিদ দিচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো। যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপোর্ট এরপর থেকেই বাংলাদেশসহ আরও কিছু দেশকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাড়াতে তাগিদ দিয়ে আসছে।


ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর চিঠিতে যা আছে

গত মঙ্গলবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেওয়া এক চিঠিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গত মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী যে চিঠি লিখেছেন, তাতে গত বছরের নভেম্বর থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদার করতে যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তাদের কয়েক দফা সফরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়। প্রাথমিক মূল্যায়নের পর নিরাপত্তা ঘাটতি চিহ্নিত করে তা দূর করার জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরির কথাও চিঠিতে উল্লেখ আছে।

চিঠিতে বলা হয়, সম্প্রতি মিসর ও সোমালিয়ায় বিমানে হামলার পর এটি যুক্তরাজ্যের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। সন্ত্রাসের ব্যাপারে ন্যূনতম ছাড় না দেওয়ার নীতির ধারাবাহিকতায় যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট যে, বিমানবন্দরের নিরাপত্তার সমস্যা দূর করতে শেখ হাসিনা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

এতে আরও বলা হয়, সর্বশেষ মূল্যায়নে যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তারা বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় ধারাবাহিকভাবে বড় ধরনের ঘাটতি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।

ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, “শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তাজনিত সমস্যার মূলে আছে প্রশিক্ষিত নিরাপত্তাকর্মী এবং যথাযথ নজরদারির ঘাটতি। তাই আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা পূরণের লক্ষ্যে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের জন্য আপনাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানাই।”

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তারা পণ্য নিরাপত্তায় ঘাটতি খুঁজে পেয়েছেন। পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞার ফলে যুক্তরাজ্যগামী সরাসরি ফ্লাইটের অন্যান্য নিরাপত্তার ব্যাপারে বিমানবন্দরের কর্মীদের মনোযোগের সঙ্গে কাজ করতে সহায়ক হবে।

ডেভিড ক্যামেরন বলেন, “আমি আশা করি, দ্রুততার সঙ্গে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারটি আপনি বুঝতে পারছেন। আকাশপথে সত্যিকারের ঝুঁকি আছে এবং আমাদের নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। আকাশপথে একটি নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাকাঠামো গড়ে তুলতে বিশ্বের সব দেশের অবশ্যই আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা পূরণ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে আপনাকে সহযোগিতার জন্য যুক্তরাজ্য সরকার তৈরি আছে।”


বিজিএমইএ’র সংবাদ সম্মেলন

যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞা তুলতে দ্রুত উদ্যোগী হতে সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন দেশের পোশাক শিল্প মালিকেরা ।

“যুক্তরাজ্যকে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি বাজার, এটা ধরে রাখতে সরকারকে দ্রুত উদ্যোগী হতে হবে,” বিজিএমইএ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গতকাল এ কথা বলেন সংগঠনটির সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান।

তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন যুক্তরাজ্যে পণ্য পাঠাতে হলে সিঙ্গাপুর, হংকং, থাইল্যান্ড কিংবা দুবাই হয়ে পাঠাতে হবে, যাতে খরচও বাড়বে, সময়ও বেশি লাগবে।

মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিনিয়তই বাড়ছে। তাই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সরকারি পর্যায়ে আলোচনা করে দ্রুত সমাধান হওয়া জরুরি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।