অস্ত্র রপ্তানির আগ্রহ প্রধানমন্ত্রীর, আরও চিন্তা করার পরামর্শ পর্যবেক্ষকদের
2015.05.22

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-প্রতিরক্ষা সমরাস্ত্র আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানির ওপর মনোযোগী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এর ফলে এক বছর আগে অস্ত্র রপ্তানির লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা গতি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত বছরের মে মাসে সরকারি-মালিকানাধীন অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা (বিওএফ) তাদের তৈরি অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিদেশে রপ্তানি করার জন্য সরকারি ছাড়পত্র চেয়েছিল। বাণিজ্য মন্ত্রনালয় সেই অনুমতি এখনো দেয়নি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এটা করতে চাইলে সরকারকে অবশ্যই দেশের রপ্তানি নীতিমালা সংশোধন করতে হবে। এই নীতিমালা অনুযায়ী বর্তমানে অস্ত্র ও গোলাবারুদ রপ্তানি করা নিষিদ্ধ।
আর এটা যদি অনুমোদিত হয়, তাহলে বাংলাদেশ হবে ভারত ও পাকিস্তানের পর দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)-এর অস্ত্র রপ্তানিকারী তৃতীয় সদস্য।
যদিও গত ৩০ বছরে “অস্ত্র ছাড়া বাকি সবকিছু” রপ্তানি করার নীতিই বাংলাদেশের রপ্তানি নীতিমালার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল, কিন্তু বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা এখন সেটা পরিবর্তন করার আশা করছে।
বিশ্বব্যাংকের “বিশ্ব উন্নয়ন সূচক ২০১২: বিশ্বে সামরিক ব্যয় ও অস্ত্র স্থানান্তর” শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে সর্বশেষ যুদ্ধাস্ত্র ও গোলাবারুদ রপ্তানি করেছিল।
যদিও দেশের রপ্তানি নীতিমালা পরিমার্জনের মাধ্যমে দেশটি বহুল-প্রয়োজনীয় রাজস্ব অর্জন করতে পারে, কিন্তু এই বিষয়ে কিছু কিছু পর্যবেক্ষক জোরালো আপত্তি প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ হিসেবে অস্ত্র রপ্তানিকারকের পরিচয় ভাবমূর্তির সংকট বাড়াতে পারে।
“অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে এক কাতারে শামিল হওয়াটা বাংলাদেশের জন্য ভালো কোনো বিষয় হবে না। এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সংসদে এর সব ভালো ও খারাপ উভয় দিকে নিয়েই আলোচনা করা উচিত,” বেনারকে জানান দুর্নীতি-বিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
তার মতে, এর বদলে বাংলাদেশের জন্য উচিত হবে দারিদ্র্য নিরসন, খাদ্য নিরাপত্তা, মানব সম্পদ উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মনোযোগ দেওয়া।
গত ২১ মে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে এসে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মত বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী সমরাস্ত্র আমদানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদন বাড়ানো এবং সম্ভব হলে অস্ত্র রপ্তানির ওপর গুরুত্ব দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানায় সেনাবাহিনীর চাহিদা মেটানোর জন্য ৭.৬২ মিলিমিটার অটো রাইফেল, বিভিন্ন ক্যালিবারের কার্তুজ এবং হ্যান্ড গ্রেনেড উৎপাদন করছে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিওএফ শুধুমাত্র রাইফেল ও গোলাবারুদ তৈরি করে থাকে, তাই সামরিক বাহিনীকে গড়ে তোলার জন্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র, ট্যাংক, যুদ্ধজাহাজ ও উড়োজাহাজ আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়।
সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ব্যাপক সামরিক সম্প্রসারণের ফলে, যুদ্ধাস্ত্র ও গোলাবারুদ আমদানি ২০০৫ সালে ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০১৩ সালে ৬৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছিল।
এই প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী অস্ত্র উৎপাদন ও রপ্তানির কথা বললেন।
“বিভিন্ন বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রের আমদানিনির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নিতে আমি সমরাস্ত্র কারখানা কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি। সবকিছু আমদানি না, আমরা নিজেরা করব এবং যেটা উপযুক্ত হবে, যুক্তিসংগত হবে, প্রয়োজনে আমরা রপ্তানিও করব,” জানান প্রধানমন্ত্রী।
দেশের সমরাস্ত্রের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে সমরাস্ত্র কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়ে শিগগিরই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান সরকার প্রধান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ (এনডিসি), আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ, মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি), ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টাল সেন্টার এবং এনসিও’র একাডেমির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে।
এ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী সেনা সাঁজোয়া বহরের জন্য চতুর্থ প্রজন্মের ট্যাঙ্ক এমবিটি-২০০০, বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক রাডার সিস্টেম, সঞ্চালিত কামান, এপিসি এবং আর্মির জন্য অন্যান্য আধুনিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করে, আর্মি অ্যাভিয়েশনের জন্য আধুনিক হেলিকপ্টার ক্রয়ের কথা উল্লেখ করেন। মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার এবং নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নৌবাহিনীর জন্য মেরিন পেট্রল এয়ারক্র্যাফট, আধুনিক ফ্রিগেট ও যুদ্ধজাহাজ সংগ্রহ করার প্রসঙ্গও তুলে ধরেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, বিমান বাহিনীতে শর্ট রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স ইউনিট গঠনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। কক্সবাজারে অগ্রবর্তী ঘাঁটি হিসেবে একটি পূর্ণাঙ্গ নতুন ঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছে। ইউনিটসমূহের যথাযথ তত্ত্বাবধানের লক্ষ্যে স্থাপন করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু অ্যারোনটিক্যাল সেন্টার’।
বিমান বাহিনীর জন্য মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান, নৌবাহিনীর জন্য আধুনিক ফ্রিগেট ও যুদ্ধজাহাজ সংগ্রহের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যাঁরা মামলা দায়ের করেছেন তাঁরা সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারেনি।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান কেনা হয়। এরপর বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে বিমান কেনায় দুর্নীতির অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা করে।
মিগ-২৯ এর প্রসঙ্গ টেনে সমরাস্ত্র কেনার ‘প্রয়োজনীয়তা’ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী কর্মকর্তাদের বলেন, “ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধি রাম সর্দার হয়ে তো লাভ নেই।”
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে আরও কার্যকর ও সময়োপযোগী বাহিনীতে পরিণত করতে আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সংগ্রহ অব্যাহত থাকবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বিভিন্ন পুনর্গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রশংসা করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিজের হাতেই রেখেছেন। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর গত বছর এপ্রিলে সর্বশেষ তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ প্রতিবছর কি পরিমাণ সমরাস্ত্র আমদানি করে, তা কখনোই প্রকাশ করা হয় না। তবে প্রতি অর্থবছরের বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতের জন্য বড় অঙ্কের বরাদ্দ রাখা হয়।
চলতি অর্থবছরের বাজেটেও প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ আছে ১৬ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি।
সশস্ত্র বাহিনীর জন্য শিক্ষা, অবকাঠামো, সমরাস্ত্রসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও সরকারের সহযোগিতার চিত্রও তিনি কর্মকর্তাদের সামনে তুলে ধরেন।
সেই সঙ্গে সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা যাতে ভবিষ্যতে নিজেদের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে পারেন, সেদিকে ‘বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়ার’ কথা বলেন তিনি।
“আমাদের উচিত এখন পুলিশবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও দক্ষ শ্রমিক তৈরি করা। আমাদের প্রযুক্তি এখনো অস্ত্র রপ্তানির পর্যায়ে যায়নি। তাই এমন উদ্যোগ দেশে–বিদেশে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে,” বেনারকে জানান সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মহিউদ্দিন আহমেদ, যিনি দেশের প্রথম সারির একজন কলাম লেখক।
মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “চীন থেকে দুটি সাবমেরিন কেনা হয়েছে। কিন্তু ইন্টারনেটে গেলে দেখা যায়, জাতিসংঘের ১৯৪টি দেশের মধ্যে ২৬টি দেশে সাবমেরিন আছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে—বাংলাদেশ কী সাবমেরিন কেনার পর্যায়ে গেছে?”
অস্ত্র ক্রেতা থেকে বিক্রেতা হওয়ার প্রক্রিয়াঃ
বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের জন্য একটি ভালো পদক্ষেপ হিসেবে সমর্থন করার মাধ্যমে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ২০১৩ সালে অস্ত্র রপ্তানির প্রস্তাব অনুমোদন করে। এরপর গত বছরের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ (এএফডি) এতে সম্মতি দেয়।
ওই বছরের মার্চ মাসের শুরুর দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই প্রস্তাবটি অনুমোদন করে। তবে প্রস্তাবটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এবং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নেতৃত্বে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির অনুমোদন পেতে হবে।
“আমরা দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র আমদানি করে আসছি। এখন আমরা হিসাব করার চেষ্টা করছি যে উচ্চমানসম্পন্ন ও বিদেশে চাহিদা আছে এমন অস্ত্র ও গোলাবারুদ রপ্তানি করে আমরা কত টাকা উপার্জন করতে পারব,” বলেছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, যিনি স্পর্শকাতর এই ইস্যুতে নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে চান না।
তবে, বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে.এম. সফিউল্লাহ অস্ত্র রপ্তানির উদ্যোগকে সমর্থন করেন।
“সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত রয়েছে এমন কোনো দেশে আমরা অস্ত্র রপ্তানি করছি না সেটি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া অস্ত্র রপ্তানি করার মধ্যে আমি কোনো ক্ষতি দেখি না,” জানান সফিউল্লাহ।