প্রশাসন দলীয়করণমুক্ত করার অঙ্গীকারে বন্ধুর পথে আশরাফের যাত্রা

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.07.20
BD-ashraf গত বৃহস্পতিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান সৈয়দ আশরাফ। ঈদের ছুটি শেষে সোমবার মন্ত্রণালয়ে প্রবেশের আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা হয় তাঁর। ২০ জুলাই,২০১৫
বেনার নিউজ

৯০-এর পর প্রতিটি সরকারই ক্ষমতায় এসে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দলীয় আনুগত্যের বিবেচনায় পদোন্নতি ও পদায়ন দিয়ে এসেছে। এইরকম একটা সংস্কৃতি বদলিয়ে নবনিযুক্ত মন্ত্রী কতটা পরিবর্তন আনতে পারবেন তাই নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

নবনিযুক্ত জনপ্রশাসন   মন্ত্রী   সৈয়দ   আশরাফুল   ইসলাম   প্রথম   কর্মদিবসে ঘোষণা দিয়েছেন যোগ্যদের   মূল্যায়ন   করা   হবে এবং প্রশাসনে দলীয়করণ হবে না। কাজটি   মোটেও   সহজ  নয়  উল্লেখ করে জনপ্রশাসন  বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা এখন  প্রায়   অসম্ভব   ব্যাপার   হয়ে   পড়েছে।      

বর্তমান সরকারের গত সাড়ে ছয় বছরে কয়েক দফায় প্রায় আড়াই হাজার কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ফলে উপসচিব থেকে ওপরের পদগুলোতে আর শূন্য পদ নেই। পদের চেয়ে কর্মকর্তা অনেক বেশি হওয়ায় সচিবালয়ে পদায়ন, বসার জায়গা ও দায়িত্ব নিয়ে কাড়াকাড়ি অবস্থা চলছে।

সর্বশেষ গত এপ্রিলে সরকার ৮৭৩ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিতে গিয়ে আরও কয়েকশ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি ‘বঞ্চিত’ করা হয়েছে। এই  ‘গণপদোন্নতি’  নিয়ে  জনপ্রশাসনে   মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে।

একপক্ষের অভিযোগ, যোগ্যতা থাকার পরও রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে অনেককে বঞ্চিত করা হচ্ছে। যদিও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলে আসছে, পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতাই প্রাধান্য পাচ্ছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়টি সব সময় প্রধানমন্ত্রীর কাছেই থাকত। বর্তমান সরকার এই মেয়াদে প্রথম সেখানে একজন প্রতিমন্ত্রী দিয়েছে, এরপর গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেলেন একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী, যিনি সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

“প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত এককভাবে তিনি নিতে পারবেন না। কিন্তু যথেষ্ট অবদান রাখতে পারেন। এই মিশন নিয়ে যদি উনি এগিয়ে যান, লেগে থাকেন তাহলে প্রশাসনে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে,” বেনারকে জানান সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার।

সাবেক ওই সচিব মনে করেন, দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখার অনুভূতিটাই নেই। তারা যদি এটা করত তাহলে সরকার ও জনগণ উপকৃত হতো।        

গত   বৃহস্পতিবার   জনপ্রশাসন   মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান সৈয়দ আশরাফ।ঈদের ছুটি শেষে সোমবার  মন্ত্রণালয়ে প্রবেশের আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা হয় তাঁর।

এর আগে গত ৯   জুলাই স্থানীয়   সরকার   মন্ত্রণালয়  থেকে  আশরাফকে  সরিয়ে বৈদেশিক   কর্মসংস্থান  ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ  হোসেনকে ওই মন্ত্রণালয়ের   দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার এক সপ্তাহ পর সৈয়দ আশরাফকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের   দায়িত্ব  দেওয়া  হয়, যেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ছিল।

“যে পরিমাণ দলীয়করণ প্রশাসনসহ সবক্ষেত্রে হয়েছে তাতে এর লাগাম টেনে ধরাটা কঠিন,” বেনারকে জানান হাফিজউদ্দিন খান, যিনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ট্রাস্টি এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।

তাঁর মতে, সামগ্রিক রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকলে প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত করা সম্ভব। তবে ব্যক্তি বিশেষের পক্ষে এটা করা আর সম্ভব নয়।

সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা জানান, নব্বইয়ের পর থেকে প্রশাসনে দলীয়করণ মাত্রাতিরিক্ত হয়ে পড়ে। আর প্রকাশ্যে দলীয়করণ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চের মাধ্যমে। তখন সাবেক সচিব মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে একদল কর্মকর্তা–কর্মচারী ওই মঞ্চে যোগ দিয়ে আলোচনায় আসেন।পরে মহীউদ্দীন মন্ত্রী হন এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে প্রশাসনের ওই সব কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ পদ পান।

ওই সময় থেকে পদোন্নতি ও ভালো পদ দেওয়া শুরু হয় মুখ দেখে, দলীয় বিবেচনায়। তবে তদবিরেও অনেকের পদোন্নতি হয়। এরপর বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর এসব কর্মকর্তাকে ‘শাস্তিমূলক ওএসডি’, বাধ্যতামূলক অবসর বা পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়। এরপর এটি নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে।

জনপ্রশাসনের সূত্র মতে, এমন ভারসাম্যহীন অবস্থার মধ্যে কেউবা সামনে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন, কেউ কেউ পেছাতে পেছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকার উপক্রম হয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জনপ্রশাসনে এখন ভিন্নমতের কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়া কঠিন। সরকারি দলের সমর্থকরাই প্রশাসনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন। ভিন্নমতের কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা থাকলেও তাঁরা কোণঠাসা, ওএসডি বা কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কাজ করছেন।  

প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতার পর জনপ্রশাসনে সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ১৮টি কমিশন বা কমিটি গঠন করে  সংস্কারের নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি কখনো।

বরং অপরিকল্পিত কয়েকটি বিসিএস ব্যাচের কারণে প্রশাসনের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। ফলে প্রশাসনের কর্মকর্তারা পদোন্নতি ও ভালো পদ পেতে রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজেছেন বারবার।

সর্বশেষ ‘সরকারি কর্মচারী আইন’ মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে, যা প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে বলে মনে করেন জনপ্রশাসন সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।

“আমরা প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। সাম্প্রতিক সময়ে বড় ধরনের পদোন্নতি দেওয়া হলে পদায়ন প্রক্রিয়া দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করা গেছে,” বেনারকে জানান ড. কামাল নাসের।   

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।