অভিজিৎ হত্যার এক বছর, অগ্রগতি সামান্যই
2016.02.24

আবারও বাংলা একাডেমি জুড়ে নতুন বইয়ের গন্ধ। বইমেলায় নিত্য লেখক-পাঠকের সমাবেশ। সেই ভিড়ে আসেন নিহত লেখক অভিজৎ রায়ের পিতা অধ্যাপক অজয় রায়ও। খুঁজে ফেরেন বিগত বছরগুলোতে মেলায় ছেলের ছড়িয়ে দেওয়া সৌরভ। সেই সঙ্গে তিনি ছড়িয়ে যান সন্তান হত্যার বিচার না পাওয়ার হতাশাও।
প্রায় এক বছর আগে বইমেলার বাইরে এক সন্ধ্যায় দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়। বছর ঘুরে আবারও সেই দিন দোর গোঁড়ায় আসলেও ধরা পড়েনি তার হত্যাকারীরা। হতাশ পরিবার তাকিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে। তবে তদন্তে ‘উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি’র কথা বলছে পুলিশ। যাতে একমত পোষণ করেছে এই মামলার তদন্তে সহায়তাকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রও।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিজিৎ রায়সহ অন্যান্য ব্লগার হত্যার বিচার নিয়ে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ঠ আন্তরিক নয়। যার প্রভাবে এসব হত্যা মামলার তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।
পাওয়া গেছে ডিএনএ নমুনা
শুরু থেকেই অভিজিৎ হত্যা মামলার তদন্তে সহায়তায় এগিয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকেব৷ তবে পুলিশ জানায়, শুধুমাত্র মামলার আলামত পর্যবেক্ষণ, ফরেনসিক এবং ডিএনএ টেস্টের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে এফবিআই৷ সুনির্দিষ্টভাবে অপরাধীদের চিহ্নিত করতে হবে এদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই।
পুলিশ জানিয়েছে, ইতিমধ্যে অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের যে ১১ আলামত পরীক্ষার জন্য এফবিআইকে দেওয়া হয়েছিল, সেখানে কিছু ডিএনএ নমুনা পাওয়া গেছে। ওই নমুনা প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর, তা মিলিয়ে দেখা হবে এ হত্যায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার আটজনের সঙ্গে। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সাংবাদিকদেরকে এসব তথ্য জানান ডিএমপি-র কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম৷
অভিজিৎ হত্যার পর কয়েক দফায় পুলিশের হাতে আটক হওয়া এই আটজন হলেন- শফিউর রহমান ফারাবী, ব্রিটিশ নাগরিক তৌহিদুর রহমান, সাদেক আলী, আমিনুল মল্লিক, জুলহাস বিশ্বাস, আবুল বাশার, জাফরান হাসান ও মান্নান রাহী। পুলিশ ও র্যাবের মতে, ফারাবী ছাড়া বাকিরা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী। পুলিশের মতে, হত্যাকাণ্ডে পাঁচজন সরাসরি হত্যাকর্মে অংশ নেয়।
বৃহস্পতিবার অগ্রগতি জানাবে পুলিশ
এ বিষয়ে মনিরুল ইসলাম বুধবার বেনারকে বলেন, ‘আমরা এফবিআইকে দেওয়া আলামতগুলোর ফরেনসিক রিপোর্ট এখনো পাইনি। এর বাইরে আমরা আমাদের মত করে মামলার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। চেষ্টা করছি’।
এছাড়া বৃহস্পতিবার একটি সংবাদ সম্মেলনে অভিজিৎ রায়ের মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে সাংবাদিকদের জানানো হবে বলে তিনি জানান।
তবে এর আগে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, এখনও পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য কোনো প্রত্যক্ষদর্শী বা সাক্ষী পাওয়া যায়নি৷ এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলামতের ফরেনসিক রিপোর্ট না পাওয়ায় মামলাটির তদন্ত প্রক্রিয়া থেমে আছে৷
সন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র
এদিকে লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় পুলিশের সহযোগিতামূলক আচরণে যুক্তরাষ্ট্র সন্তুষ্ট বলে কয়েকদিন আগে জানান বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া ব্লুম বার্নিকাট। যুক্তরাষ্ট্রে আলামত পরীক্ষায় কিছু ডিএনএ নমুনা ধরা পড়ার কথা প্রকাশের পরদিন ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি ‘প্রকৃত অপরাধীরা’ ধরা পড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন।
বার্নিকাট সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা খুব জটিল একটি মামলা। এতে বড় অগ্রগতি আসবে বলে আমরা আশা করছি।’
হত্যাকারীরা বিচারের আওতায় আসার অপেক্ষায় পরিবার
প্রতিদিনই সন্তান হত্যা মামলার অগ্রগতির দিকে তাকিয়ে থাকেন অধ্যাপক অজয় রায় ও তাঁর পরিবার। পুলিশ কিংবা পত্রিকা মারফত খোঁজ রাখেন পুঙ্খানুপুঙ্খু সব অগ্রগতির।
বেনারের সঙ্গে আলাপকালে শুরুতেই জানান সে অগ্রগতির কথা। বলেন, ‘মামলার অগ্রগতি যে একেবারেই হয়নি, তা বলবো না। তদন্ত চলছে।
এখানকার লোকাল তদন্ত সেল এফবিআইয়ের ফলাফলের জন্য অপক্ষো করছে। এফবিআই হত্যাকারীদের ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করেছে। প্রতিবেদনটা এখন পর্যন্ত লোকাল গোয়েন্দা অফিসে আসেনি। সেটা আসলেই সন্দেভাজনদের প্রোফাইলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখবে পুলিশ।
তিনি বলেন, ‘পুলিশের কাছে জেনেছি, হত্যাকারীদের চিহ্নিত করেছে গোয়েন্দা বিভাগ। তবে তারা বলছে না, কেউ গ্রেফতার হয়েছে। বলছে, নজর বন্দি আছে। এসব সন্দেভাজনরা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলাম। পুলিশ বলেছে- তারা দেশের ভেতরেই আছে।’
এই অগ্রগতিতে ‘সন্তুষ্ট’ কিনা তেমন প্রশ্নের জবাবে সন্তান হারানোর কষ্ট বয়ে বেড়ানো এই পিতা বলেন, ‘সন্তুষ্ট হওয়ার প্রশ্ন নেই। যতদিন পর্যন্ত হত্যাকারীরা ধরা না পড়ে, বিচারের কাটগড়ায় যতদিন তাদেরকে দাঁড় করানো না হয়, ততদিন পর্যন্ত সন্তুষ্টির কোন প্রশ্ন আসে না। আমি আশাবাদি মানুষ। আশা করি একটা কিছু বেরিয়ে আসবে। দেখা যাক…’
শেষ কথাটিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সাবেক অধ্যাপক।
‘সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্তরিক নয়’
পুলিশের পক্ষ থেকে এ মামলার অগ্রগতি নিয়ে নানা সময় নানা ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও পুলিশ ও সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। পরিকল্পিত এসব হতাকান্ডের বিচার না হলে দেশ ধীরে ধীরে জঙ্গিবাদের দিকে যাবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
অভিজিত হত্যাকাণ্ড বিষয়ে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বেনারকে বলেন, ‘এ হত্যাকান্ডের ব্যাখ্যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলেছে- হত্যাকান্ডটি ক্লু-লেস। তার মানে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য-প্রমান তাদের কাছে নেই। এটা স্পষ্টতই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি বড় ধরনের ব্যর্থতা। কারণ, পুলিশের নাকের ডগার সামনে এমন একটি হত্যাকাণ্ড হয়ে গেল, অথচ এক বছরেও তারা কোন সুরাহা করতে পারল না। আমি মনে করি এটা তাদের বিরাট ব্যর্থতা।’
একই সঙ্গে সরকারের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র।
ইমরান বলেন, ‘অভিজিৎসহ ব্লগার হত্যাকাণ্ডগুলো কোন বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। একের পর তালিকা ধরে ধরে এসব হত্যাকান্ড চালানো হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় কয়েকদিন আগে একজন হিন্দু ধর্মীয় গুরুকে হত্যা করা হল। কিন্তু কোন ব্যবস্থা আমরা দেখছি না। এর আগেও মাজারের পীর, শিয়াদের উপর, খিস্ট্রান ধর্মযাজকের উপর হামলা করা হয়েছে। এমনকি বিদেশি হত্যাকাণ্ডও এর বাইরে না। এগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে সম্পৃক্ত। যারা করছে তারা খুব পরিকল্পিতভাবেই করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব অপরাধীদের দমন করা, বিশেষ করে জঙ্গিবাদী কার্যক্রম যারা করছে, যারা তালিকা ছাপিয়ে মানুষ হত্যা করছে; তাদের ব্যাপারে যদি ব্যবস্থা না নেয় তার ফলাফল জঙ্গিবাদ উত্থানের আশঙ্কা। সরকারের আন্তরিকতার উপর নির্ভর করছে এ রাষ্ট্রের ভবিষ্যত কী হবে।’
যেভাবে খুন হন অভিজিৎ
গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে রাত ন'টার দিকে বের হন অভিজিৎ রায় ও তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা৷ পায়ে হেঁটে শাহবাগের দিকে যাওয়ার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-র উল্টো পাশে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের মূল গেটের উত্তর দিকে তাঁদের ওপর হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা৷ তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে অভিজিৎ রায়কে। ওই ঘটনায় গুরুতর আহত হন বন্যা৷ পরে কিছুটা সুস্থ হয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। অভিজিত ও বন্যা দুজনেই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। বইমেলা উপলক্ষ্যে দেশে এসেছিলেন তারা।