আইন-আদেশেও নিশ্চিত হয়নি সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.02.19
BD-bangla দেশের সর্বত্র দোকান ও প্রতিষ্ঠানের নাম ও সাইনবোর্ড বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিতে লেখার চল দিন দিন বাড়ছে।
বেনার নিউজ

ঢাকা শহরের যেকোন রাস্তার দুপাশে তাকালেই চোখে পড়বে বাংলা লেখার চেয়ে বিদেশি ভাষায় লেখা  নাম ফলক বা বিলবোর্ডের ভিড়। বড় শপিং মল থেকে খুদে চায়ের দোকান- বেশিরভাগেরই নামে আছে অ-বাংলা ভাষার প্রলেপ।

অথচ বাংলা ভাষার জন্য রক্তদানকারী রাষ্ট্র হিসেবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে নানা আদেশ ও নির্দেশনা জারি হয়েছে বাংলাদেশে। তারপরেও সেসব আইন বা নির্দেশনা তোয়াক্তা না করে দেশের সকল স্থানে নামফলক, সাইনবোর্ড, বক্তৃতা, উচ্চশিক্ষাসহ অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ কাজই চলছে অ-রাষ্ট্র ভাষায়। এমনকি আদেশদানকারী আদালতেও নেই বাংলার ব্যবহার।

বাংলা ভাষা ব্যবহার না করলে এবং এ–সংক্রান্ত আইনটি লঙ্ঘন করলে অসদাচরণের দায়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ জারি হলেও আজ পর্যন্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কারো বিরুদ্ধেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিতে সব সরকারই শুধু আদেশ–নির্দেশ দিয়ে গেছে, সেসবের কঠোর প্রয়োগ কেউ করেনি।

এটাকে রক্তে অর্জিত বাংলা ভাষার প্রতি স্পষ্টত অবহেলা ও উদাসীনতা বলে অভিযোগ এনেছেন ভাষা আন্দোলনকারীরা।


সরকারি কাজেই নিশ্চিত হয়নি বাংলার ব্যবহার

স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সরকার সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সংবিধান, ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ২০১৪ সালে উচ্চ আদালতের রায় এবং ডজন খানেকেরও বেশি সরকারি আদেশ, পরিপত্র বা বিধিতে বাংলা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবুও সরকারি কাজের সবক্ষেত্রে আজও নিশ্চিত করা যায়নি রাষ্ট্রভাষা বাংলার ব্যবহার।

আবার এই বাংলাভাষা প্রচলন আইন কিছু সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য হলেও বাদ পড়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম। তবে উচ্চ আদালত সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি সকল ধরনের প্রতিষ্ঠানকেও বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়।


‘উদাসীনতা ও অবহেলা’

৬৮ বছর আগে যারা ভাষার জন্য লড়াই করেছিলেন তারা এটাকে মোটেই ভালভাবে দেখলেন না। তাদের অভিযোগ- যোগ্য সম্মান দেওয়া হচ্ছেনা রাষ্ট্রীয় ভাষাকে।  

এ বিষয়ে ভাষা সৈনিক আহমদ রফিক অভিযোগ করেন, ‘উদাসীনতা ও অবহেলার কারণেই সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার আজও নিশ্চিত করা যায়নি।  সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও আদালতের নির্দেশসহ এতোসব উদ্যোগ থাকার পরও বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এমন অবনতি শুধু মাত্র আমাদের সদিচ্ছার অভাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

২৩ বছর বয়সে ভাষা আন্দোলন করা এই ভাষা সৈনিক বেনারকে  বলেন, ‘সেই অনুযায়ী বরং বিচার বিভাগকে সালাম জানাতেই হয়। কারণ প্রত্যক্ষ কাজ না হলেও বিচারকেরা বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে ভেবেছেন, এটা কার্যকর করার নির্দেশও দিয়েছেন তারা।’


ঢিলে তালে চলছে বাবাকো’র কাজ

এদিকে সরকারি আইন বা অধ্যাদেশগুলো বাংলায় প্রমিতিকরণ করতে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠা হয় বাংলাভাষা বাস্তবায়ন কোষ (বাবাকো)। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৩৫ বছরে  এ পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ১৪ টি এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের ৫৭টি আইন বা অধ্যাদেশ প্রমিতিকরণ করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাবাকো এ পর্যন্ত প্রশাসনিক পরিভাষা, পদবি পরিভাষা ও সরকারি কাজে ব্যবহারিক বাংলা এই তিনটি পুস্তিকা বের করেছে। এছাড়া সচিবালয় নির্দেশিকা ২০১৪ প্রণয়নে সাচিবিক দায়িত্ব পালন করে বাবাকো।

তবে সরকারি কাজকর্মে বাংলা ব্যবহারে বেশকিছু অগ্রগতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন- জনপ্রশাসন সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।


বাংলার ব্যবহার নিয়ে যত উদ্যোগ

বাংলাদেশের সংবিধানে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ বলে উল্লেখ রয়েছে।  এতে আরো বলা হয়- সংবিধানে বাংলা ও ইংরেজি উভয় পাঠের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে  প্রাধান্য পাবে বাংলা পাঠ।

স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতা হাতে আসলে দেশের সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালুর প্রতিশ্রুতি দেন। যুদ্ধ শুরুর পর ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে বাংলাকে দেশের সরকারি ভাষার ঘোষণা দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।

এরপর ১৯৭৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে মন্ত্রিসভার বৈঠকে নয়টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলাকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া ও ইংরেজি ভাষার ওপরে বাংলাকে স্থান দেওয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ছিল।

একই বছরের ৩ মে বঙ্গভবন থেকে জারি করা আদেশে রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করা সমস্ত নোট, সার–সংক্ষেপ বা প্রস্তাবাদি বাংলায় করতে বলা হয়। পরদিন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের স্মারকলিপিতে রাষ্ট্রপ্রতির কাছে পেশকৃত নথিপত্রের নোটশিট এবং সারাংশ বাংলায় লিখতে বলা হয়। ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর অফিস আদালতের সব কাজ সাধু ভাষায় সম্পন্ন করতে বলা হয়।

এরপর ১৯৯৬ সালের ২৮ মে সচিব কমিটির সভার সিদ্ধান্তে আনুষ্ঠানিক দলিলাদির ক্ষেত্রে অফিস–আদালতে সর্বত্র সাধু ভাষা ব্যবহার করা ব্যতিত  অন্যান্য ক্ষেত্রে এর বাধ্যবাধকতা থাকবে না- বলে জানানো হয়। ১৯৯৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বাংলায় একটি মামলার রায় দেয়।

২০১৩ সালে এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে বাংলার প্রচলন, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার গাড়ির নম্বর প্লেট, বিভিন্ন দপ্তরের নামফলক, গণমাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। এরপর একই বছরের ১৪ মে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোকে সাইনবোর্ড ও নামফলক বাংলায় লেখা নিশ্চিত করতে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।


অ-রাষ্ট্রভাষার দৌরাত্ম

রাজধানীর উত্তরা, গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিদেশি ভাষার চাপে বাংলাভাষার একেবারে কোণঠাসা অবস্থা।  এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকান-পাটসহ প্রায় সর্বত্রই বাংলার প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলার হাজারো নজির প্রতিদিন দেখা যায়। রাজধানীর বাইরেও রাষ্ট্রভাষার যেনতেন ব্যবহার সর্বত্র।

বিভিন্ন সড়কের দুপাশ জুড়ে সাইনবোর্ডের প্রায় সবগুলোতেই বিদেশি ভাষার দৌরাত্ম। এমনকি বিদেশি শব্দগুলোও বাংলায় রেখা। বাংলার ব্যবহারের এই করুণ দশা সম্পর্কে ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক বলেন, এখন থেকে কয়েক দশক আগেও দেশের সব রাস্তার পাশে বাংলায় লেখা ব্যানার, নামফলক লেখা হতো। এখন বিদেশি ভাষার দৌরাত্মে বাংলার ব্যবহার কমেছে, তবে ভুল বাংলার ব্যবহার বেড়েছে কয়েকগুন।


থেমে গেছে ভাষা সৈনিকদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ

এদিকে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের তালিকা তৈরির কাজ থেমে গেছে। আদালতের এক নির্দেশে একটি তালিকা করার পর আর কোন তালিকা করেনি সরকার গঠিত চার সদস্যের কমিটি। প্রথম ওই তালিকায় ১৪ নারীসহ জীবিত ৬৮ জনকে ভাষা সৈনিক হিসেবে সরকার স্বীকৃতি দেয় সরকার।

ভাষা আন্দোলনের ৬৮ বছর পর ভাষা সৈনিকদের তালিকা করা দুঃসাধ্য ব্যাপার বলছে সংশ্লিষ্ট কমিটি।
তবে প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা প্রথম তালিকাটি বহাল থাকবে কিনা, সে বিষয়েও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।

এ বিষয়ে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বেনারকে বলেন, ভাষা আন্দোলন ছিল গণ-মানুষের আন্দোলন। যারা ভাষা ও দেশের প্রতি আবেগ ও ভালোবাসা থেকে এ আন্দোলন করেছিলেন, তাদেরই ভাষা সৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁদের তালিকা তৈরি করা অত্যন্ত কঠিন কাজ।  

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।