বাংলাদেশ ব্যাংকের জমানো টাকা কোথায় গেলো? কে চুরি করলো?
2016.03.08

বাংলাদেশে আবারও অর্থ হাতিয়ে নেওয়া কাণ্ড নিয়ে তুলকালাম। তবে এবারের ঘটনা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে, আর ক্ষতিগ্রস্ত খোদ রাষ্ট্র। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে শ্রীলংকা ও ফিলিপাইনে সরিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। যার পরিমান প্রায় ১০ কোটি ডলার বা ৮শ কোটি টাকা বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
এই অর্থের পরিমাণ সম্পর্কে বাংলাদেশের এই কেন্দ্রীয় ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না জানালেও কর্মকর্তারা বিবিসিকে জানান, বেহাত হওয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় দশ কোটি মার্কিন ডলার।
প্রায় এক মাস আগে ঘটনাটি ঘটলেও এ নিয়ে মুখ খোলেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। এমনকি বিষয়টি জানানো হয়নি অর্থমন্ত্রীও। তবে মিডিয়ায় প্রকাশের পর হ্যাকিংয়ের ঘটনা স্বীকার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, খোয়া যাওয়া কিছু অর্থ উদ্ধার করা গেছে, বাকিটা উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
এদিকে এ ঘটনা অস্বীকার করেছে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির বিরুদ্ধে মামলা করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। বিশ্লেষকরাও বলছেন, এ ঘটনার দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গত ৫ ফেব্রুয়ারি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ হ্যাক করেছে চীনভিত্তিক একটি হ্যাকার গ্রুপ। চক্রটি প্রায় ১০ কোটি হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে সরিয়ে শ্রীলংকা ও ফিলিপাইনে নেয়। শ্রীলংকায় সরিয়ে নেয়া সে অর্থ এরই মধ্যে উদ্ধার করা গেছে বলে জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর ফিলিপাইন থেকে অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুজন কর্মকর্তা দেশটি সফর করে এসেছেন।
জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নগদ অর্থ বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা হয়।
খবর ফাঁস হয় ফিলিপাইনে
ঘটনাটি জানার পর পুরোপুরি চেপে যায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক থেকে চীনা হ্যাকারদের বাংলাদেশের সঞ্চিত অল্থ হাতিয়ে নেওয়ার খবর গত ২৯ ফেব্রুয়ারি খবর প্রকাশ করে ফিলিপা্ইনের সংবাদপত্র ইনকোয়ার। পত্রিকাটির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেডারেল ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভের অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ফিলিপাইনের কয়েকটি ব্যাংকে প্রবেশ করে।যা সেখান থেকে কয়েকটি ক্যাসিনোসহ একাধিক হাত ঘুরে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই খবর অনুযায়ী, এটাই ওই দেশের সবচেয়ে বড় মানি লন্ডারিং ঘটনা।
মিডিয়ায় প্রকাশের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বীকারোক্তি
নানা আলোচনার প্রেক্ষিতে ইনকোয়ারের প্রতিবেদন প্রকাশের ছয়দিন পর গত ৭ মার্চ সোমবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অর্থ পাচারের ঘটনা স্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কায় অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে। ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কা থেকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার করা হয়েছে। অবশিষ্ট অংকের গন্তব্য সনাক্ত করে তা ফেরত আদায়ের বিষয়ে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইটেলিজেন্স ইউনিট ফিলিপাইনের এন্টি-মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সক্রিয় রয়েছে। ইতোমধ্যে ফিলিপাইনের এন্টি-মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষ তাদের দেশের আদালতে মামলা দায়ের করে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবগুলোর ফ্রিজ আদেশ আদালত থেকে সংগ্রহ করেছে।
‘দোষীদের সনাক্ত করতে নিয়োজিত বাংলাদেশ ব্যাংক’
এদিকে অর্থ হ্যাকিংয়ের বিষয়টি জানার পরেও সরকারের উচ্চ মহলকে না জানানোর বিষয়ে বেনারের কাছে মুখ খোলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক (প্রটোকল) এ.এফ.এম. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, “প্রায় চার সপ্তাহ আগে বিষয়টি জেনে এ যাবত আমরা ফাইন্ডিংস বের করছিলাম। এটা কোথা থেকে কিভাবে হয়েছে, কারা কারা জড়িত, কীভাবে ফেরত নিয়ে আসা যায় সেসব কাজে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়োজিত রয়েছে।”
সাফাই দিয়ে তিনি বলেন, “জানাজানি হলেও সব পাওয়া যায়না। সবাই জানলে যে টাকা উদ্ধার হবে কিংবা যারা এ অপকর্ম করলো-তারা কি ধরা পড়বে? আমাদের মূল টার্গেট যা খোয়া গেছে, তা উদ্ধার করা, যারা এ খোয়া যাওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাদেরকে সনাক্ত করে ধরা। সে সফলতার দিকে বাংলাদেশ এগুচ্ছে।”
তবে কী পরিমাণ টাকা খোয়া গেছে, আর কী পরিমাণ টাকা উদ্ধার হয়েছে তদন্তের স্বার্থে তা জানানো সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
স্বীকার করেনি ফেডারেল ব্যাংক
তবে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অফ নিউইয়র্ক এ ঘটনা স্বীকার করেনি। ব্যাংকটির মুখপাত্র আন্দ্রেয়া প্রিস্ট এক টুউটার বার্তায় ঘটনায় নিজেদের দায় অস্বীকার করেছে। ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমে কোনো ধরনের হ্যাক হয়নি বলে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে জানান তিনি।
প্রয়োজনে মামলা: অর্থমন্ত্রী
ফেডারেল ব্যাংক দায় অস্বীকার করলেও তাকে ছেড়ে কথা বলছেন না বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী। খোয়া যাওয়া অর্থ ফেরত পেতে প্রয়োজনে মামলা করার কথা জানিয়েছেন তিনি।
মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের এখানে কোনো রকমের দোষ কিছু নেই। এটা ফেডারেল রিজার্ভের, যারা এটা সেখানে হ্যান্ডেল করেন, তাদের কোনো গোলমাল হয়েছে। তারা যদিও বলছে, তাদের কোনো দায়িত্ব নেই; তবে এটা হতেই পারে না।”
একদিন আগেও এ বিষয়ে কিছু না জানা মন্ত্রী বলেন, আমরা তার (ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক) বিরুদ্ধে কেস করব। তাদের কাছে টাকা রাখছি, তারাই এই জন্য রেসপনসিবল। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে কেইস করব।”
নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি
বাংলাদেশের অভিযোগ ও ফেডারেল ব্যাংকের অস্বীকার পরিস্থিতি ঘোলাটে করছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম।
তিনি বেনারকে বলেন, ‘অর্থ খোয়া গেছে সেটা নিশ্চিত, কিন্তু কিভাবে গেছে; সেটা পরিষ্কার করা হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, হ্যাক করে অর্থ চুরি করা হয়েছে, কিন্তু ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশেই অর্থ স্থানান্তর হয়েছে। এখন বিষয়টি নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। আর এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কারো দায় থাকলে তার বিরুদ্ধেও দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ”।
অর্থ কীভাবে স্থানান্তর হলো সেটা জানা গেলেই ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনা এড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন মির্জ্জা আজিজ।
সাইবার সতর্কতার আদেশ
এদিকে বিদেশে সাইবার অপরাধে আক্রান্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে সাইবার নিরাপত্তা সার্বিকভাবে নিশ্ছিদ্র করার প্রক্রিয়া জোরালোভাবে সচল রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার একদিকে যেমন গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধি এবং আধুনিক বিশ্বের ব্যাংকিং সেবাকে সকলের দোরগোড়ায় পৌছে দিয়েছে; অন্যদিকে তেমনি বাড়িয়ে তুলেছে সাইবার আক্রমণের ঝুঁকিকে। উন্নত বিশ্বে ব্যাংকিং খাতে সাইবার আক্রমন অনেকটা নৈমিত্তিক ঘটনা হলেও বাংলাদেশের জন্য একেবারেই নতুন। আর্থিকখাতের অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক এই সাইবার অপতৎপরতার বিষয়ে অবহিত হওয়া মাত্রই তা মোকাবেলায় তৎপর রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই ব্যাংকসমূহের অনুসরণীয় বিষয়ে সার্কুলার জারী করেছে এবং পরবর্তীতে যাতে আর কোন বড় ধরণের আর্থিক ক্ষতি না হয় সে বিষয়ে বাংলাদেশে কার্যরত সকল তফসিলী ব্যাংকের সাথে মত বিনিময়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।