রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রের ফায়ারআই
2016.03.11

‘কলিজার মধ্যে ব্যথা লাগে, এত্তগুলো টাকা।…’ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঞ্চিত অর্থ চুরি করার খবরে সামাজিক গণমাধ্যমে এমন হতাশা প্রকাশ করেছেন সুরাইয়া সুমি নামের একজন বাংলাদেশি।
ধনী থেকে গরীব, উচ্চ বিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত। যারাই বিরাট অংকের এ অর্থ খোয়া যাওয়ার ঘটনা জেনেছেন তারাই হা-হুতাশ করছেন। সবার কণ্ঠে একই প্রশ্ন- ফেরত পাওয়া যাবে জনগণের এ অর্থ? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও। বিরাট এই ধাঁধা মেলাতে তারা সাহায্য চেয়েছে নিজস্ব পরামর্শক ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিক্স’র কাছে।
তবে ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিক্সই আবার অর্থ লোপাটের তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার নিরাপত্তা কোম্পানি ফায়ার আইয়ের ম্যানডিয়েন্ট ফরেনসিক বিভাগের সহযোগিতা চেয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিক্স’র খবর নিশ্চিত করা হলেও ফায়ার আই’র যুক্ত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেনি।
বিশ্বের বড় বড় সাইবার চুরির ঘটনাগুলোর মধ্যে কয়েকটির তদন্ত করে বেশ পরিচিতি পেয়েছে সিলিকন ভ্যালির কোম্পানি ফায়ারআই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট দু’জনকে উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে আট কোটি ডলারের বেশি চুরির ঘটনা তদন্তেও এ প্রতিষ্ঠানটি যুক্ত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিক্সই ফায়ারআইকে সম্পৃক্ত করেছে।
এ কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতাও ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাকেশ আস্তানাই। যিনি এক সময় বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি বিভাগে পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান, “শ্রীলংকার কেন্দ্রিয় ব্যাংক ২০ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ ব্যাংককে ফেরত দিয়েছে।অন্যদিকে ফিলিপাইনের এন্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিল বাকি ৮১ মিলিয়ন ডলার খুঁজে বের করার জন্য কাজ করছে”।
তিনি এও জানান, হ্যাকাররা আর প্রায় ৮৭০ মিলিয়ন ডলার চুরি করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। আমেরিকার ব্যাংক আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিলো, আমরা সেই অংক দিতে বলেছি কিনা। আমরা তখন জানিয়ে দেই, আমরা সেই নির্দেশনা দেই নাই।
রয়টার্সের খবর অনুযায়ী, হ্যাকড হওয়া বাংলাদেশের অর্থ চুরির বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ও জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেছে বলেও উল্লেখ করা হয়। যদিও এফবিআই, ইউএস সিক্রেট সার্ভিস, জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট ও ইউএস ট্রেজারির ক্রাইমস এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্কের কারো কাছ থেকে ঘটনার সত্যতা জানতে পারেনি রয়টার্স।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে শ্রীলংকা ও ফিলিপাইনে সরিয়ে নেয় একটি চক্র। যার পরিমান প্রায় ১০ কোটি ডলার বা ৮শ কোটি টাকা বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। প্রায় এক মাস আগে ঘটনাটি ঘটলেও এ নিয়ে মুখ খোলেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। এমনকি বিষয়টি জানানো হয়নি অর্থমন্ত্রীকেও। তবে মিডিয়ায় প্রকাশের পর হ্যাকিংয়ের ঘটনা স্বীকার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, খোয়া যাওয়া কিছু অর্থ উদ্ধার করা গেছে, বাকিটা উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে এবার এসব সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম শোনা যাচ্ছে।
বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সচিবালয়ের মহাব্যবস্থাপক এ এফ এম আসাদুজ্জামান বেনারকে বলেন, “ফায়ারআইয়ের নাম সম্পর্কে আমি অবহিত নই। আজ পর্যন্ত যেটুকু জানি তা হল- অর্থ হারানো তদন্তের পুরো বিষয়টি দেখছেন রাকেশ আস্তানার নেতৃত্বে একটি দল। তিনি বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা এবং আন্তর্জাতিক সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ। এছাড়া আমাদের নিজস্ব বিশেষজ্ঞরাও এ কাজে জড়িত। আরো কাজ করছে বিএফআইইউ নামের একটি গ্রুপের সদস্যরা। এছাড়া ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে গভর্নর দেশের আইনশৃঙ্খলা কাজে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে বিষয়টি অবহিত করে। তারাও এটা খতিয়ে দেখছে”।
তিনি জানান, “রাকেশ আস্তানার নেতৃত্বে তার প্রতিষ্ঠানকে তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি কীভাবে ঘটল, বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ত্রুটি আছে কি না তা পর্যালোচনা এবং টাকা ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া ও আগামীতে দেশের কোনো ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সেজন্য নিরাপত্তা দেয়াল তৈরি করে দিতে তিনি কাজ করছেন”।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্স লিখেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমে ঢুকেই হ্যাকাররা পেমেন্ট ট্রান্সফারের ক্রেডেনশিয়াল চুরি করে। এরপর ভুয়া সুইফট মেসেজের মাধ্যমে ফেডারেল রিজার্ভকে অর্থ স্থানান্তরের অনুরোধ পাঠায়। এক সপ্তাহের মধ্যে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে প্রায় তিন ডজন অনুরোধ যায়। যার প্রেক্ষিতে সব মিলিয়ে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার স্থানান্তর করতে বলা হয়। এর চারটি অনুরোধের প্রেক্ষিতে ফিলিপাইনের এক ব্যাংকের পাঁচটি অ্যাকাউন্টে ফেডারেল রিজার্ভ পাঠায় মোট ৮১ মিলিয়ন ডলার। আর পঞ্চম আদেশে শ্রীলঙ্কার একটি ‘ভুয়া’ এনজিওর অ্যাকাউন্টে ২০ মিলিয়ন ডলার পাঠানো হলেও বানান ভুলে সন্দেহ জাগায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়।
ফিলিপাইনে যাওয়ার অর্থের একটি অংশ কোনো ব্যাংকে নেই বলে খবর প্রকাশ করে দেশটির একটি সংবাদ মাধ্যম। এই অর্থের কিছু অংশ ফিলিপাইনের বিভিন্ন জুয়ার বাজারে উড়ছে বলেও খবর রয়েছে।
‘অর্থ উদ্ধার সম্ভব তবে সময় সাপেক্ষ’
বাংলাদেশের ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’ হল খোয়া যাওয়া এ অর্থ আদায় সম্ভব কিনা। তবে অর্থনীতিবিদরা এ বিষয়ে আশার বাণী শোনাচ্ছেন।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “টাকাটা উদ্ধার করা সম্ভব হতে পারে। কারণ, এটা এখন বহুল প্রচারিত ঘটনা। ফিলিপাইন্স কর্তৃপক্ষও চাইবে যাতে তাদের দেশের সুনাম ক্ষুন্ন না হয়। এজন্য তারা হয়ত যথেষ্ঠ সহযোগিতা করবে। তবে সময় কতদিন লাগে সেটা দেখার বিষয়। ”
তবে এই অর্থের কোন অংশ যদি কোনো ব্যাংকে না থাকে, তাহলে সেটা উদ্ধার করা কঠিন হবে বলে মনে করেন তিনি।
এছাড়া এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন কর্মকর্তার জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “এ বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আশা করি কমিটি সঠিক বিষয়টি তুলে আনতে সক্ষম হবে।”
তদন্ত প্রতিবেদন দেখে সিদ্ধান্ত
এদিকে হ্যাক করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরির ঘটনায় সম্পূর্ণ তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়েই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
শুক্রবার সাংবাদিকদের তিনি “চুরি কীভাবে ঘটেছে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। তা তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্তের মাধ্যমে পুরো ঘটনা জানা গেলে বলা যাবে-বিচার বাংলাদেশে নাকি অন্য কোথায় হবে?”
তিনি বলেন, “আইনের দিক দেখলে বলতে হবে এটি একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী কার্যক্রম। আমেরিকার ব্যাংক, টাকা বাংলাদেশের, গেছে ফিলিপাইন আর শ্রীলঙ্কায়। সে ক্ষেত্রে আমাদের আইন ও অন্যান্য দেশের আইন কতটা কার্যকর হবে সেটা তদন্তের পর বলা যাবে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।”