বাংলাদেশে ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে রদবদলের ইঙ্গিত
2016.03.14

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০ কোটি ডলার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরির ঘটনা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় চলছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি ঘোলাটে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হল এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রণালয়ের মধ্যকার দুরত্ব এখন স্বচ্ছ কাঁচের মত স্পষ্ট। যা বাংলাদেশে ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে রদবদলের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আবার বিভিন্ন মহল থেকে সংশ্লিষ্টদের পদত্যাগের দাবিও জোরদার হচ্ছে।
গোয়েন্দা নজরদারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা
বিদেশি প্রযুক্তিবিদদের পাশাপাশি দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার হ্যাক করে অর্থ লোপাটের ঘটনার তদন্ত করছে। তদন্তের অংশ হিসেবে আইনশঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গত রোববার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ১১টি কম্পিউটার জব্দ করেছেন। কম্পিউটারগুলোর হার্ডডিস্ক ও সংশ্লিষ্ট সার্ভারের ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহভাজন বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০-১২জন কর্মকর্তার একটি তালিকা তৈরি করে তাদের উপর নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের দাবি এই কর্মকর্তাদের মধ্যে চারজনের ইউজার আইডি ও সুইফট কোড হ্যাক করে অর্থ লোপাট করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থেই এদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।
জানা যায়, এসব কর্মকর্তা গত এক বছরে কি ধরনের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রাংশ ব্যবহার করেছেন, কিংবা কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তা খতিয়ে দেখা হয়েছে। এমনকি তাদের বিদেশ সফরও খতিয়ে দেখা হয়েছে।
সমালোচনার মুখে গভর্নর, পদত্যাগ দাবি
এক মাসেরও বেশি সময় আগের অর্থ লোপাটের ঘটনা সরকারকে না জানানো, হারানো অর্থ উদ্ধারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ ও কর্মতৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে এমন পরিস্থিতিতে পূর্ব নির্ধারিত একটি সেমিনারে যোগ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্ণরের ভারত সফর করা আরো সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সেই সঙ্গে প্রবল হচ্ছে তার পদত্যাগের দাবি। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রধান বিরোধী দল এমনকি সরকারের ভেতর থেকেও এ দাবি উঠেছে।
সোমবার আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নুহ-উল-আলম লেনিন ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে লিখেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির নৈতিক দায় গভর্নর আতিউর রহমান এড়াতে পারেন না। পরম আশ্চর্যের বিষয়, এত বড় একটা কেলেঙ্কারির বিষয় মাসাধিক আগে জানা সত্বেও আতিউর এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অর্থমন্ত্রী ও ব্যাংকিং বিভাগের সচিবকে জানান নি কেন? ঘটনার পর দুই বার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভা হলেও সেখানে বিষয়টি গোপন করা হয়েছে। বিষয়টি চেপে যাওয়ার এই চেষ্টা ‘কার স্বার্থ রক্ষার জন্য’? এত বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা জানা সত্বেও আতিউর কীভাবে নির্লিপ্ত থেকে দিল্লি ভ্রমণ করতে পারেন? কেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করলেন না? তদন্ত করে এর সত্যতা প্রমাণিত হলে আতিউরের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের এই নেতা।
এমন ‘দায়িত্বহীন’ আচরণের জন্য অবিলম্বে আতিউর রহমানকে গভর্নরের পদ থেকে অপসারণ করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদও রিজার্ভ থেকে অর্থ লোপাটের ঘটনা প্রতিরোধে ব্যর্থতার অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি জানান।
তিনি বলেন, ‘জনগণের টাকা হ্যাকিংয়ের নামে চুরি হচ্ছে, পাচার হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ৮০০ কোটি টাকা হ্যাক করার কথা তিনি কিছু জানেন না। যে সরকার গৃহস্থের বদলে চোরকে নিরাপদ রাখতে বেশি ব্যস্ত থাকে তারা তো কিছুই জানবে না। এ অবস্থায় অর্থ পাচারের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। এখন সেই প্রবণতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, “রিজার্ভের অর্থ কারো পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ নয়। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের রক্ত পানি করা কষ্টার্জিত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ হিসেবে সংরক্ষিত হয়। অথচ সেই অর্থ খোয়া যাওয়া ঘটনাটি ঘটার প্রায় এক মাস পরেও তা প্রকাশ করা হয়নি। এতে সুস্পষ্টভাবেই বোঝা যায়-ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার অপপ্রয়াস চলছিল।”
প্রশ্ন উঠেছে অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া পদক্ষেপেরও। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রী সভার একজন সদস্য বেনারকে বলেন, “খোয়া যাওয়া অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ পর্যাপ্ত নয়। অর্থ চুরি গেছে বাংলাদেশের। যার কিছু অংশ ফিলিপাইনে রয়েছে। সে অর্থ ফেরত দিতে সে দেশটি যে ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে, সেই ধরনের কার্যকরী উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের নিতে দেখা যায়নি।”
পরিবর্তনের ইঙ্গিত
এদিকে রিজার্ভে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লোপাটের ঘটনাটি শুরু থেকে না জানানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। যে ক্ষোভ থেকে ব্যাংকিং খাতে বড় পরিবর্তন আসার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
“ডেফিনেটলি দেয়ার উড বি চেইঞ্জেস। এতো বড় একটা সিরিয়াস ব্যাপার। আই টেক ইট ভেরি সিরিয়াসলি।” সোমবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের কাছে দৃঢ় কণ্ঠে এমনটাই বলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ বিষয়ে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করার কথাও রয়েছে তার।
জানা যায়, সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকের শুরুতেই অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। তবে প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি।
তবে "আইন ও বিধি অনুযায়ী" কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে পাওয়া গেছে বলে একাধিক মন্ত্রিসভা সদস্য জানান।
ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “যে মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী বিরাট বিরাট প্রকল্প করছেন, রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ, জিডিপি ৭ শতাংশ হবে বলে মনে করছি... সেই মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ঘটনা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এ ব্যাপারে অবশ্যই বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করব। ব্যাপারটা ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী- আমরা সকলেই গুরুত্ব সহকারে নিয়েছি।”
দিল্লী সফরে থাকা আতিউর রহমানের ফেরার পর পরবর্তি পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত দেন অর্থমন্ত্রী। সোমবার বিকেলে চারটার দিকেই দেশে ফেরেন আতিউর। তবে তার অপেক্ষায় থাকা গণমাধ্যমকর্মীদের এড়িয়ে যান তিনি। ফিরেই অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের কথা থাকলেও সূত্র জানায় সে কাজ ফোনেই সেরে নেন তোপের মুখে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের এই গভর্ণর।
এদিকে স্থগিত হয়েছে অর্থ লোপাটের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ডাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের জরুরি বৈঠক। গত রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম আলম (পদাধিকার যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য) কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গিয়ে চারজন ডেপুটি গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকের পর পরিচালনা পর্ষদের একটি জরুরি সভা আহবান করেন।
রিজার্ভের অর্থ চুরি এবং এ সংক্রান্ত তদন্ত বিষয়ে অর্থমন্ত্রী মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন আহবানের পর সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা জানান, “বিশেষ কারণে পরিচালনা পর্ষদের সভা স্থগিত করা হয়েছে। পরবর্তী সভার তারিখ এখনও নির্ধারণ হয়নি।”
তদন্ত কমিটি
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে বিশাল অংকের টাকা চুরির ঘটনা তদন্তে চার সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সোমবার রাতে কমিটি গঠনের কথা জানানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে।