ব্লগার অনন্ত হত্যা, বিশ্বজুড়ে বইছে নিন্দার ঝড়
2015.05.13

বাংলাদেশে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার ঘটনায় বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় বইছে। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সের পক্ষ থেকে এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচারের সম্মুখীন করার আহবান জানানো হয়েছে।
আর এ হত্যাকাণ্ডকে বাংলাদেশে ধর্ম ও বাক স্বাধীনতার প্রতি সহিংস অসহনশীলতার ভয়ংকর প্রবণতারই অংশ বলে অভিযোগ তুলেছে নিউইয়র্ক ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
এছাড়াও ‘হত্যার ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক’ বলে বলে মন্তব্য করেছে সম্প্রতি অনন্তের করা ভিসা আবেদন প্রত্যাখানকারী দেশ সুইডেন। যদিও নিরাপত্তার কারণে সুইডেনে আশ্রয় চেয়ে কোনো আবেদন জানাননি অনন্ত।
এদিকে খুন হওয়ার পর একদিন পেরিয়ে গেলেও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তবে অনন্ত হত্যার ঘটনায় একটি মামলা করেছেন নিহতের বড় ভাই রত্নেশ্বর দাশ। মঙ্গলবার রাতে সিলেট নগরীর বিমানবন্দর থানায় অজ্ঞাতপরিচয় চারজনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন তিনি।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বিমানবন্দর থানার ওসি গওসুল হোসেন বেনারকে বলেন, “ মামলার এজাহারে অজ্ঞাতনামা চারজনকে আসামি করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতেই মামলাটি রেকর্ড করা হয়।”
পুলিশ বলছে, হত্যাকারীদের সনাক্ত ও গ্রেপ্তারের জন্য মঙ্গলবার রাত ভর অভিযান চালানো হলেও কাউকে পাওয়া যায়নি। এর আগে তিনজন ব্লগার খুনের ঘটনার সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের মিল আছে কিনা, সেটিও খতিয়ে দেখছেন তারা।
এ বিষয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার রহমতউল্লাহ জানান, “এর আগে তিনজন ব্লগার খুন হওয়ার ঘটনার সঙ্গে অনন্ত হত্যাকাণ্ডের মিল দেখা যাচ্ছে। সে অনুযায়ী আমরা এগুচ্ছি।”
অনন্ত হত্যার প্রতিবাদে সিলেট নগরে বুধবার সকাল ছয়টা থেকে অর্ধদিবস হরতাল পালন হয়।
মঙ্গলবার সকালে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সিলেটের সুবিদবাজার এলাকায় ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী অনন্ত বিজয় দাশকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা হয়েছে। এই খুনের পর আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে আনসার বাংলা ৮ নামে একটি টুইটার একাউন্ট থেকে দাবি করা হয়।
এ প্রসঙ্গে সিলেটের পুলিশ কমিশনার কামরুল আহসান বলেন, “বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি শুনেছি। কোন তথ্যকেই উড়িয়ে দিচ্ছিনা। অন্য সব বিষয়ের সঙ্গে এ বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।”
এদিকে অনন্ত হত্যার ঘটনায় বিশ্বে তোলপাড় উঠেছে। ঘটনার কয়েক ঘণ্টার পর থেকেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। বর্বর হামলার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে।
‘এ ধরনের বিদ্বেষী হামলা কেবল হামলার শিকার ব্যক্তিদেরই থামিয়ে দেয় না, এগুলো বাংলাদেশে ধর্মীয় বিষয়ে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশকারী সবার কাছে ভীতিকর বার্তাও দেয়।’ উল্লেখ করে এই নৃশংস হামলার ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন বলে বিবৃতি দিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
মঙ্গলবার দেওয়া এক বিবৃতিতে সংস্থাটির এশিয়াবিষয়ক পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস সরকারের উদ্দেশ্যে আরো বলেন, বাংলাদেশে ধর্ম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হামলা যে সহ্য না করা হবে না, তা স্পষ্ট করা উচিত।
জাতিসংঘের ঢাকায় নিযুক্ত আবাসিক প্রতিনিধি রবার্ট ওয়াটকিন্স এক অনন্ত হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ তদন্ত দাবি করে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার পাশাপাশি আগেকার হত্যাকাণ্ডগুলোর তদন্তও দ্রুত শেষ করে ওইসব ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার কথা পুনর্ব্যক্ত করে সংস্থাটি।
একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এই ঘটনার তীব্র নিন্দা এবং দোষীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার আহবান জানায়। বাংলাদেশে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ থাকা উচিত বলেও পৃথক বিবৃতিতে জানান তারা।
অনন্ত হত্যাকাণ্ডের পর সুইডেন সরকারের ব্যাপক সমালোচনা করেছে সুইডেনেরই লেখকদের সংগঠন ‘পেন’। এই সংগঠনটির আমন্ত্রণে অনন্ত বিজয় দাশের স্টকহোম যাওয়ার কথা ছিল। এজন্য তিনি ভিসার আবেদন করেন ঢাকার সুইডিশ দূতাবাসে। তবে প্রত্যাখ্যাত হয় সে ভিসা আবেদন। ‘পেন’ বলছে, সুইডেন সরকার ভিসা আবেদনটি প্রত্যাখান না করলে নিহত হওয়ার দিন অনন্ত বিজয় দাশ বাংলাদেশের বদলে সুইডেনে থাকতেন।
সাম্প্রতিক এই ভিসার আবেদন প্রত্যাখান করার কথা স্বীকারও করেছে সুইডেন। বুধবার এক বিবৃতিতে দেশটির সরকার জানিয়েছে, অনন্ত দাশের ভিসার আবেদন প্রত্যাখান করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি নিরাপত্তার কারণে সুইডেনে আশ্রয় চেয়ে কোনো আবেদন জানান নি। তাকে হত্যার ঘটনা খুবই মর্মান্তিক উল্লেখ করে এই বিবৃতিতে সুইডিশ সরকার জানায়, অনন্ত আশ্রয়ের আবেদন জানালে বিষয়টি মূল্যায়ন করে দেখতেন তারা।
এদিকে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সূত্র জানায়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) হিটলিস্টে রয়েছে সরকারের কাছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের জমা দেয়া ৮৪ জন ব্লগার। যাতে নিহত ব্লগার রাজীব হায়দার ও অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে অনন্ত বিজয়ের নামও ছিল। পুলিশের ধারণা, হত্যার উদ্দেশ্যেই ওই তালিকা তৈরি করে আনসারুল্লাহ।