মুক্তচিন্তার বই প্রকাশ কমেছে, প্রকাশক গ্রেপ্তার, ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ
2016.02.16

প্রগতিশীলদের অন্যতম আড্ডার স্থল নামে আজিজ সুপার মার্কেটের একটি বইয়ের দোকানে চলছিল নিত্যদিনের বেচাকেনা। হঠাৎ একজন সে অভিজিত রায়ের লেখা কয়েকটি বই চাইলেন।
শুনেই আঁতকে উঠলেন বিক্রেতা। তার এ আতঙ্কের কারণ বুঝতে পেরে নারী ক্রেতাটি এবার গলার স্বর নামিয়ে বইগুলোর নাম বলতে থাকেন। বিক্রেতা এবার তাদেরকে বসিয়ে বেশ গোপন স্থান থেকে ক্রেতার চাওয়া বইগুলোর মধ্য থেকে দু’টি বই বের করে জানালেন লেখকের অন্য কোন বই তাদের সংগ্রহে নেই। এই কয়েকটি বই রাখা হয়েছে, সেটিও অনেক ঝুঁকি নিয়ে।
বই বেচাকেনা পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটছিল বেনার প্রতিবেদকের সামনেই।
এভাবে লুকিয়ে বই কেনা ও বেচার কারণ জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বিক্রেতা বলেন, 'এগুলো সেই অভিজিৎ রায়ের লেখা বই, যিনি মুক্তাচিন্তার বই লেখার কারণে গত বছর বইমেলা চলাকালীন সময়ে খুন হন'।
অভিজিৎসহ ব্লগার হত্যার পর এ ধরনের মুক্ত চিন্তার বই বিক্রি শুধু নয়, প্রকাশও হচ্ছে না। পূর্ব প্রকাশিত বইগুলোও বাজারে পাওয়া যায় না। পূর্ব পরিচিত কিছু ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী কয়েকটি বই আমার দোকানে রেখেছি। তবে সেটা অত্যন্ত সাবধানে। অপরিচিত কোন ক্রেতার কাছে বিক্রিও করছি না।'
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শুধু আজিজের বইয়ের দোকানগুলোতেই শুধু নয়, খোদ অমর একুশে বইমেলায়ও অভিজিৎ এবং এ ধরনের মুক্তমনা লেখকদের বই কেউ বিক্রি করছে না।
অভিজিৎসহ বিভিন্ন ব্লগার হত্যার রেশে এবারের বই মেলায় মুক্তমনা লেখকদের বই প্রকাশ ব্যাপকভাবে কমেছে। এমনকি ইসলামের প্রতি অবমাননার অভিযোগ তুলে একটি প্রকাশনীর স্টলও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গত বছর বই মেলাতেও একইভাবে রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করা হয়েছিল।
সংশ্লিষ্টরা এটিকে মুক্তচিন্তার উপর আঘাত বলে মনে করছেন। তারা বলছেন, মূলত: মৌলবাদীদের হামলার ভয়েই লেখক কিংবা প্রকাশকদের 'সেল্ফ সেন্সরসিপ' থেকে এ ধরনের বই কম প্রকাশ হচ্ছে। আর মৌলবাদীদের দমন না করে মুক্তমনা বইয়ের প্রকাশনী বন্ধ করে সরকার তাদেরকেই সমর্থন দিচ্ছে। এখনি এ ধরণের পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে ভবিষ্যতে আর কেউ মুক্তমনা বই লিখতে সাহস পাবে না। হুমকির মুখে পড়বে সাহিত্যের মুক্ত চর্চা।
ব-দ্বীপ প্রকাশনের মালিক আটক-রিমান্ডে
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে গত সোমবার বিকেলে অমর একুশে গ্রন্থমেলার ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টলটি বন্ধ করে দেয় পুলিশ। একইসঙ্গে ওই প্রকাশনীর বেশ কয়েকটি বই জব্দ করা হয়।
পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টলে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অনুভূতিতে আঘাত করে এমন বই প্রদর্শনের অভিযোগ পাওয়া যায়। অনুসন্ধানেও বিতর্কিত লেখার প্রমাণ পাওয়ায় ওই প্রকাশনী বন্ধ সংশ্লিষ্ট বই জব্দ করা হয়েছে।
ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টলটি নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ এমন কারণ দেখিয়ে স্টল বন্ধ করার পর আটক করা হয় ব-দ্বীপ প্রকাশনের সত্ত্বাধিকারী ও ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামের বইয়ের সম্পাদক শামসুজ্জোহা মানিক, মুদ্রাকর ফকির তসলিম উদ্দিন কাজল ও বিপণন কর্মকর্তা শামসুল আলমকে। বইটির অনলাইন সংস্করণ থাকায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এ তিনজনের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ (২) ধারায় একটি মামলা (নম্বর-২৩) দায়ের করেছেন শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক মাসুদ রানা।
মঙ্গলবার এ তিনজনেক আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন শাহবাগ থানা পুলিশ। এ আবেদনের শুনানি শেষে ঢাকার বিচারিক আদালত শামসুজ্জোহা মানিকের ৫ দিন, ফকির তসলিম উদ্দিন কাজলকে ২ দিন এবং শামসুল আলমকে ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
স্টল বন্ধের পর শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুবকর সিদ্দিক বলেন, ‘বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক থেকে আমরা জানতে পারি, ব-দ্বীপ প্রকাশনীতে এমন কিছু বই প্রদর্শিত হচ্ছে যেগুলোর মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে। পরে অনুসন্ধানে বিতর্কিত লেখার প্রমাণ পাওয়া গেছে।’
তার মতে, ‘ইসলাম বিতর্ক’ বইটিতে মহানবী (সা.) সম্পর্কে আপত্তিকর লেখা পাওয়া গেছে। এ কারণে বইটি জব্দ করা হয়েছে ও মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদের সঙ্গে কথা বলে স্টলটি বন্ধ করা হয়েছে।
অন্য পাঁচটি বই জব্দ প্রসঙ্গে আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘এ বইগুলোতেও বিতর্কিত লেখা আছে কি-না তা অনুসন্ধান করার জন্যই সেগুলো জব্দ করা হয়েছে। বইগুলো হলো- শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল রচিত ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’, এম এ খান অনূদিত ‘জিহাদ: জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার’, শামসুজ্জোহা মানিকের ‘ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা’, একই লেখকের প্রবন্ধ সংকলন ‘ইসলামে নারীর অবস্থা’ এবং ‘নারী ও ধর্ম’। ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টলে প্রদর্শিত এ বইগুলোর সব কপি জব্দ করেছে পুলিশ। পরে নীলক্ষেত ও কাঁটাবন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বইটির আরও ৭৫টি কপি জব্দ করে পুলিশ।’
পুলিশের তথ্যে স্টল বন্ধ
বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ বলেন, ‘পুলিশ আমাদের বলেছে, ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো বই প্রদর্শিত হচ্ছে। স্টলটি নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এ কারণে প্রকাশনীটির স্টল বন্ধ করা হয়েছে।’
আরো গ্রেফতারের ‘হুমকি’
মঙ্গলবার বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে ‘ইসলাম-বিতর্ক’ বইয়ে স্থান পাওয়া প্রবন্ধের ‘সব লেখকদেরও পর্যায়ক্রমে গ্রেফতার করা হবে বলে’ জানিয়েছেন রমনা জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) আব্দুল বাতেন।
আব্দুল বাতেন বলেন, ‘ইসলাম-বিতর্ক বইটিতে যেসব লেখক প্রবন্ধ লিখেছেন তাদেরও পর্যায়ক্রমে গ্রেফতার করা হবে। তবে এমন বই প্রকাশের নেপথ্যের কারণ কি তা জানার চেষ্টা চলছে।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
আবারও বইমেলার স্টল বন্ধের ঘটনায় বাংলাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। আর এ প্রতিক্রিয়ায় ভাসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো।
জাতির মনন অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন অনেকেই।
মিলটন আনোয়ার নামের একজন গণমাধ্যম কর্মী তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে গত বঝর রোদেলা প্রকাশনী বন্ধের ঘটনা স্মরণ করে লিখেছেন, ‘একবছর আগে রোদেলা, একবছর পর ব-দ্বীপ -- কোন কিছুই বদলায় না। জাতির মনন অন্ধকার থেকে অন্ধকারে হারিয়ে যায়।’
আরেক গণমাধ্যমকর্মী সুলাইমান নিলয় তার ফেইসবুকে পেজে লিখেছেন "ছোট্ট ব-দ্বীপ নয়, বিশালকার বদ্বীপও (বাংলাদেশ) নষ্টদের অধিকার চলে যাবে। এভাবে চলতে থাকলে......"
লেখার স্বাধীনতা সংকুচিত হয়
লেখক সমাজেও রয়েছে ব-দ্বীপ বন্ধের প্রতিক্রিয়া।
বিজ্ঞান লেখক, সাহিত্যিক, শিক্ষক মোহাম্মদ জাফর ইকবাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, 'এ ধরণের ঘটনা (লেখক, প্রকাশককে আটক এবং প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করা) লেখক-প্রকাশকদের মত প্রকাশের সাহস এবং স্বাধীনতাকে সঙ্কুচিত করে দেবে। এভাবে একটি প্রকাশনীর স্টলকে বন্ধ করে দেওয়া হবে তা আমি কোনোভাবেই সাপোর্ট করি না।'
তিনি বলেন, 'মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে দেওয়া না হলে উল্টো বিষয়টি ঘটে। তাই যে যেটা লিখতে চায়, বলতে চায় তাকে সেটা বলতে দেওয়া, লিখতে দেওয়া উচিৎ। তারপরে যদি মনে হয়, কেউ আপত্তিজনক কিছু লিখেছে বা বলেছে, তখন তাকে বলা যেতে পারে এটা বলো না বা লিখো না।'
অার তরুণ লেখক মাহমুদ সীমান্ত মনে করেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ তুলে এভাবে স্টল বন্ধ করে দেওয়াটা একুশে গ্রন্থমেলার চেতনার পরিপন্থি।
'ইসলাম বিতর্ক’ বইটি মুক্তচিন্তার বহিঃপ্রকাশ নয়'
তবে ব-দ্বীপ থেকে জব্দ করা ‘ইসলাম বিতর্ক’ বইটিকে মুক্তচিন্তার বহিপ্রকাশ বলতে নারাজ ইতিহাসবিদ, শিক্ষক, গবেষক মুনতাসির মামুন। তার মতে, গালাগালি করাটা মুক্তচিন্তা না। নিঃসন্দেহে অভিজিৎ মুক্তচিন্তার মানুষ ছিলেন। কিন্তু ‘ইসলাম বিতর্ক’ বইয়ের লেখককে কোনোভাবেই মুক্তচিন্তার লেখক বলা যাবে না।
তিনি বেনারকে বলেন, 'যারা একে মুক্তচিন্তার বই বলছেন, তাদের অনুরোধ করবো মা-বাবা-ভাই-বোনকে পাশে বসিয়ে বইটি পড়ে শুনানোর জন্য। যা ইচ্ছা লেখা বা বলা মুক্তচিন্তার বহিপ্রকাশ না।'
পেছন ফিরে দেখা
গত বছরের বইমেলার ২৬তম দিনে মেলা থেকে ফেরার পথে ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের চাপাতির আঘাতে খুন হন বিজ্ঞান লেখক, ব্লগার, গবেষক ডক্টর অভিজিৎ রায়। ওই বছরই ইরানি লেখক আলি দস্তি’র ‘বিশতো সেহ সাল’ নামে একটি বইয়ের অনুবাদ ‘নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর’ নামে প্রকাশ করে রোদেলা প্রকাশনী। বইটি ইংরেজিতে ‘২৩ ইয়ার্স, এ স্টাডি অব প্রোফেটিক ক্যারিয়ার অব মুহাম্মদ’ নামে প্রকাশিত হয়। বইটির প্রকাশকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকার বাংলা বাজারে বিক্ষোভের পর পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির অভিযোগের ভিত্তিতেই স্টল বাতিল করে বাংলা একাডেমী।
বইমেলার প্রায় ৮ মাস পরে ৩১ অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় নিজ প্রতিষ্ঠানে খুন হন অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন। তিনি তার জাগৃতি প্রকাশনী থেকে অভিজিতের জনপ্রিয় বই ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ প্রকাশ করেছিলেন। একই দিনে চাপাতির আঘাতে গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হন অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক শুদ্ধস্বরের আহমেদুর রশিদ টুটুল, লেখক রণদীপম বসু ও তারেক রহিম।