গণকবর আবিষ্কারের পর বিলম্বের কারণে তদন্ত বাধাগ্রস্ত হয়েছে
2019.03.28
কুয়ালালামপুর

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়ার পর নির্মম নির্যাতনের শিকার বহু বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর গণকবর আবিষ্কারের পর তদন্ত শুরু করতে মাসের পর মাস দেরি করার কারণে তদন্ত বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে দেশটির দুই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান।
এমনকি মানব পাচারকারীদের একটি আস্তানা আবিষ্কারের পর সেটি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ভয়ংকর এই অপরাধের তদন্ত ব্যাহত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে মালয়েশিয়ার মানবাধিকার কমিশন সুহাকম।
সুহাকমের সঙ্গে ফোর্টিফাই রাইটস নামক আরেকটি মানবাধিকার সংগঠন যৌথভাবে বিষয়টি তদন্ত করার পর তারা এই অভিযোগ করেছে।
তারা প্রশ্ন তুলেছে ২০১৫ সালের ১৯ জানুয়ারি দেশটির ওয়াঙ কেলিয়ান এলাকায় পাচারকারীদের আস্তানা খুঁজে পাওয়ার পারও মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ কি কারণে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গণকবর থেকে মৃতদেহ উদ্ধার ও তদন্ত শুরু করতে বিলম্ব করল?
সুহাকম এবং ফোর্টিফাই রাইটস কয়েক বছর যাবৎ তদন্ত চালিয়ে “মাছের মতো মানুষ বিক্রি” শিরোনামে ১২১ পাতার একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে ২৭০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ওয়াঙ কেলিয়ানে মানব পাচারকারীদের আস্তানা আবিষ্কার হওয়ার পরদিনই কর্তৃপক্ষ তা ধ্বংস করে দিয়েছে। পুলিশ যাতে পরবর্তীতে তদন্ত করে আলামত ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করতে না পারে সম্ভবত সে কারণেই সাক্ষ্য মুছে দেওয়ার জন্য এই কাজ করা হয়েছে। গণকবর উদ্ঘাটনের চার মাস পর ২০১৫ সালের মে মাসে মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ কবর খুঁড়ে লাশ উত্তোলনের জন্য ফরেনসিক দলকে নির্দেশ দেয়। কি কারণে দেরি করা হল তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।”
বুধবার কুয়ালালামপুরে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করে দুই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান।
পাচারের শিকার মানুষদের অনেকেই মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে পাচার হওয়া রোহিঙ্গা।
“লাশ উত্তোলনে চার মাস দেরি হওয়াও সময়মতো সেগুলোর ময়নাতদন্ত করা যায়নি এবং এর ফলে ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করা বাধাগ্রস্ত হয়েছে,” জানিয়েছে দুই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, রাসায়নিক পরীক্ষায় ১৫০টি মৃতদেহের মধ্যে শুধুমাত্র তিন ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করা গেছে। এর ফলে বিচার ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।”
এ প্রতিবেদনের ব্যাপারে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক খালিদ আবু বকর এবং মালয়েশিয়ার পুলিশ কোনো প্রকার মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গাদের গণকবর আবিষ্কারের কয়েক দিন পর থাইল্যান্ড সরকার পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে এবং অবৈধ অভিবাসীদের বহনকারী নৌকাগুলো তাদের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় সাগর উপকূলে ভিড়তে বাধা দেয়।
এরপর মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার উপকুলে সাগরে ভাসমান ৩০০০ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়। পাচারকারীরা তাদের নৌকায় করে সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।
পুলিশের ব্যাখ্যা
লাশের সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন তথ্য দিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। তারা বলছে ১৪৭টি কবর খুঁড়ে ১৩০ জন মানুষের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল।
ওই ঘটনায় কর্তৃপক্ষ ৩৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল, যাদের সবাই অতফসিলিকৃত অভিবাসী বলে তাদের সন্দেহ। তাদের সঙ্গে মানবপাচারকারীদের কোনো সংশ্রব ছিল না।
পরদিনই পুলিশ পাচারকারীদের আস্তানাটি ধ্বংস করে দেয়।
ওয়াঙ বার্মা পাহাড়ে পাচারকারীদের আস্তানা ধ্বংস করার কারণ হিসেবে ২০১৫’র জানুয়ারিতে মালয়েশিয়ার পুলিশ বলেছিল যে আস্তানাগুলো ধ্বংস না করলে সেগুলো বিদেশী এবং নাশকতাকারীরা ব্যবহার করার ঝুকি ছিল। আমরা ধ্বংস করার আগে ক্যাম্পের ছবি রেকর্ড করেছি।
মানব পাচার অব্যাহত
থাইল্যান্ডে এ রকম আরও কিছু আস্তানা এবং গণকবর আবিষ্কারের পর সেখানকার সামরিক সরকার মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে। পাচারকারী দলের ১০২ জনকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। আদালতে ৬২ জন দোষী সাব্যস্ত হন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সেনাবাহিনী তিন তারকা বিশিষ্ট জেনারেল।
অভিযান এবং বিচারকার্যক্রমের পরও নিরীহ বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজনকে পাচারকারী চক্রের অনেকেই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। পাচারের শিকার বেঁচে যাওয়া হতভাগ্যদের সুরক্ষা ব্যবস্থাও নিতান্তই সীমিত বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
ফোর্টিফাই রাইটস এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ম্যাথ্যু স্মিথ বলেছেন, “মানব পাচার এখনো চলতে দেওয়া হচ্ছে। কারণ পাচারকারীদের অনেক ক্ষেত্রেই অর্থবহ বিচারিক পরিণতি বরণ করতে হয়না।”
“যতদিন বিচারহীনতা থাকবে, তত দিন মানব পাচার থাকবে। মিয়ানমারে গণহত্যার প্রসঙ্গেও বিষয়টি একই রকম, যে কারণে শরণার্থী সংকট অব্যাহত আছে,” বলেন তিনি।
মানব পাচার আস্তানার খবর প্রচার হওয়ার পর মালয়েশিয়ায় ১২ জন পুলিশ কর্মকর্তাসহ বেশ কিছু বিদেশিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
পরবর্তীতে পুলিশ সদস্যদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছির। ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ার তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাহিদ হামিদি বলেছিলেন, “তাদের বিরুদ্ধে কোনো স্বাক্ষ্য প্রমাণ থাকায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। মালয়েশিয়ার কারও বিচারে সাজা হয়নি। দুই জন মিয়ানমারের নাগরিক, একজন বাংলাদেশী এবং একজন থাইল্যান্ডের নাগরিকসহ মোট চার বিদেশীর মানব পাচারের অভিযোগে সাজা হয়।”