অপহরনের ঘটনা বাড়ছে, মুক্তিপণ দিয়েও ফেরেনি শিশুর জীবন
2016.02.03

নিরপরাধ, নিষ্পাপ এক শিশু ১১ বছরের আবদুল্লাহ। যাকে নিয়ে ভবিষ্যতের নানা স্বপ্ন দেখেছেন মা-বাবা। কিন্তু সামান্য কিছু টাকার জন্য নিমিষেই সে স্বপ্নকে চুরমার করে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ফুলের মত একটি শিশুর জীবনকে চিরতরে ঝরিয়ে দিয়েছে আত্মীয়রুপি কিছু পাষণ্ড। চাহিদামত মুক্তিপণ আদায় করেও আবদুল্লাহকে পাশবিকভাবে খুন করে তারা। যা বাংলাদেশে অব্যাহত শিশু হত্যাকান্ডের আরও এক নির্মম প্রকাশ। এভাবে অপহরণ করে খুনের ঘটনাও নিত্য বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত বিচারের পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থাই কমাতে পারে শিশু নির্যাতন। এছাড়া সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন করার মাধ্যমে শিশুদের জন্য নিরাপদ রাষ্ট্র গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন তারা।
যেভাবে অপহরণ হয় আবদুল্লাহ
গত শুক্রবার, ছুটির দিনে স্কুল না থাকায় দুরন্ত আবদুল্লাহ দুপুরে খেয়ে খেলতে বের হয়েছিল। কিন্তু ঢাকার কেরানীগঞ্জের এলাকার নিজ গ্রাম থেকেই দিনে দুপুরে আব্দু্ল্লাহকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। ঘরে ফেরেনা সে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে না পেয়ে শেষমেষ রাতে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে তার পরিবার।
পরদিন শনিবার সকালে আব্দুল্লাহ’র পরিবারের কাছে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে একটি এসএমএস পাঠায় অপহরণকারী। তখনই অপহরণ করার বিষয়টি জানতে পারে পরিবার। মুক্তিপণ দাবির বিষয়টি জানার পর শিশুটিকে উদ্ধারে চেষ্টা চালায় পুলিশ। তবে সন্তানের জীবনের আশঙ্কায় শনিবার বিকাশের মাধ্যমে এক লাখ টাকা ও রোববার আরও এক লাখ টাকা অপহরণকারীদের পরিশোধ করা হয় বলে জানান শিশুটির পরিবারের সদস্যরা।
কিন্তু টাকা পেয়েও অপহরণকারীরা জীবিত অবস্থায় আবদুল্লাহকে মুক্তি দেয়নি। অপহরণের চারদিন পর গত মঙ্গলবার (২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে প্রতিবেশি মোতাহারের বাসা থেকে সৌদি প্রবাসী মো. বাদল হোসেনের ছেলে আবদুল্লাহ’র লাশ উদ্ধার করা হয় বলে নিশ্চিত করেন কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ওসি মো. ফেরদৌস হোসেন। মোতাহার হোসেন সম্পর্কে আব্দুল্লাহর বাবার আপন চাচা এবং মায়ের আপন মামা।
শিশুটিকে অপহরণের পর কয়েকজনকে আটক করা হয়। পুলিশ জানায়, তাদের তথ্যের ভিত্তিতে আব্দুল্লাহ’র লাশ উদ্ধার করা হয়।
ওসি ফেরদাউস হোসেন জানান, শিশুটিকে হত্যার পর লাশ ড্রামের ভিতর লুকিয়ে রাখা হয়। তবে তার আগে এসিড দিয়ে লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে খুনিরা। শরীরে এসিড ঢালার ফলে তার শরীরের কিছু অংশ পুড়ে যায়।
এ ঘটনায় মোট চারজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
চার আসামি রিমান্ডে
এদিকে শিশু আব্দুল্লাহ হত্যা মামলায় চার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে আদালত। মঙ্গলবার ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত গ্রেপ্তার আসামি মেহেদি হাসান শামীমকে সাত দিন এবং খোরশেদ আলম, আল-আমিন মাহমুদ ও নীতু আক্তারকে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেন।
তাদের প্রত্যেককে ১০ দিন করে রিমান্ড চেয়েছিলেন কেরানীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. শফিকুল আলম।
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, “সংঘবদ্ধ চক্রের অপহরণকারীরা পূর্বপরিকল্পিত ভাবে এবং ঠাণ্ডা মাথায় আব্দুল্লাহকে খুন করে। পরে লাশটি আসামি মেহেদির বাড়ির দ্বিতীয় তলার একটি নীল রঙের ড্রামে ঢুকিয়ে ঢাকনা বন্ধ করে দেয়। এছাড়া ঘটনাস্থলে লাশের পাশে পাওয়া যায় আসামি নীতুকে।’
অন্যদিকে গ্রেপ্তার খোরশেদ আলম ও আল-আমিন মাহমুদ জামিনের আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিন আবেদন নাকচ করে বিভিন্ন মেয়াদে আসামিদের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত।
দ্রুত বিচারের আশ্বাস দিলেন মন্ত্রী
আব্দুল্লাহ্ হত্যার দ্রুত বিচার এবং এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে নিহত আব্দুল্লাহ’র পরিবার, স্বজনসহ এলাকাবাসী। দোষিদের ফাঁসির দাবিতে কয়েকদফা মানববন্ধন ও ঝটিকা মিছিল করে তারা।
এলাকাবাসীর এমন দাবির মুখে আবদুল্লাহ হত্যা মামলার বিচার কয়েক মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির আশ্বাস দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।
আগামী ১৫ দিনের মধ্যে আবুদল্লাহ হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে এবং তিন থেকে চার মাসের মধ্যে বিচারকাজ সম্পন্ন হবে- বলে শিশুটির স্বজনদের আশ্বস্ত করেন তিনি।
বাদীর ও এলাকাবসীর পক্ষ হয়ে ব্যক্তিগতভাবেও বিষয়টি দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘যাতে বাদীরা কোনোরকম হয়রানির শিকার না হয় এবং আসামিরা যাতে সর্বোচ্চ সাজা পায়’।
বাড়ছে অপহরণ ঘটনা
শিশু আবদুল্লাহ’র মত অপহরণকান্ড ঘটছে প্রায় প্রতিদিন। অপহরণ ও অপহরণের পর খুন অথবা মুক্তিপণ দাবির ঘটনা সারাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে আতংক সৃষ্টি করেছে। পুলিশ সদর দফতরের তথ্যে বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতেই অপহরণ মামলা হয়েছে ১৫০টি। ২০১৫ এ সংক্রান্ত মোট মামলা ছিল ৮০২টি। ২০১৪ সালে ছিল ৯২০টি। আর ২০১৩ সালে সারা দেশে অপহরণ মামলা ছিল ৮৭৯টি।
২৯ দিনে ২৯ শিশু হত্যা!
বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধভাবে বাড়ছে শিশু নির্যাতন ও শিশু হত্যা। নতুন বছরের প্রথম মাসেই প্রতিদিন গড়ে একটি করে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে তাদের জরিপে উঠে এসেছে। গত ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত নানাভাবে খুন হয়েছে ২৯জন শিশু।
যাদের মধ্যে আবদুল্লাহর মত চারজনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয় চারজনকে। ছয়জনের লাশ মেলে নিখোঁজের পর। তিনজন স্বজনদের হাতে খুন হয়। আর বাকিদের কেউ সহপাঠি, কেউ অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হয়। আবার নির্যাতনে একটি শিশু গৃহকর্মীরও মৃত্যু হয়েছে।
শিশু অধিকার ফোরাম বলছে, ২০১২ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত শিশু হত্যার হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই হার ২০১৫ সালে ২০১৪ সালের তুলনায় কিছুটা কম ছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের প্রথম মাসেই এত শিশু হত্যার ঘটনা, আগের সব হারকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত এক হাজার ৮৫ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে বলে জানায় সংস্থাটি।
আইনের প্রয়োগ জরুরি
সংশ্লিষ্টরা বলছে, সাম্প্রতিককালে অপহরণের করে শিশু হত্যার ঘটনা বেড়েছে। এছাড়া কর্মজীবী শিশু হত্যাও অব্যাহত রয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান বেনারকে বলেন, ‘সমাজের অপরাধের প্রতিফলন শিশু হত্যাকান্ড। সমাজে অপরাধ যেমন বাড়ছে, তেমন বাড়ছে শিশু নির্যাতনের ঘটনাও। লোভ-লালসা, শত্রুতা, ক্ষোভ থেকেই শিশু হত্যার মত পাশবিক ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। তবে শিশুদের নিরাপদ জীবন নিশ্চিতে আইনের যথাপযুক্ত প্রয়োগ ও এসব ঘটনা প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়া নৈতিকতার শিক্ষাসহ সর্বস্তরে জনমত গড়ে তুলতে হবে।’