নীতিমালার অভাবে বাড়ছে গৃহ শ্রমিক নির্যাতন
2015.09.10

বাংলাদেশে থেমে নেই গৃহকর্মী নির্যাতন। পেটের দায়ে কাজ করতে এসেও তারা প্রতিনিয়ত গৃহকর্তার কাছে নির্যাতিত হচ্ছে, এমনকি হত্যাকান্ডের ঘটনাও ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গৃহকর্মী সুরক্ষায় কোন নীতিমালা বা আইন না থাকায় প্রতিদিনই এমন ঘটনা বাড়ছে।
নির্যাতিতরা দূর্বল হওয়ায় বেশির ভাগ ঘটনাই চাপা পড়ে যাচ্ছে। আর যে কয়েকটি ঘটনা মামলা পর্যন্ত গড়ায়, সেগুলোর বেশিরভাগই শেষ হয় আপোস-মীমাংসায়। কিংবা প্রমাণের অভাবে খারিজ হয়ে যায়।
উল্লেখ্য গৃহকর্মিদের সুরক্ষায় ২০১০ সালে একটি খসড়া নীতিমালা প্রনয়ন করা হলেও তা আইনের চুড়ান্ত রূপ দিতে আজ অবধি সংসদে তোলা হয়নি।
পাঁচ বছর ধরে আটকে আছে গৃহকর্মী নীতিমালা
দেশে নীতিমালা বা আইনের অভাবে গৃহশ্রমিকরা আজও শ্রমিকের স্বীকৃতি পায়নি।
জানা যায়, ২০০৬ সালের শ্রম আইনে পরিবর্তনের কারণে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হতে পারে এই ভয়ে গৃহশ্রমিকদের বিষয়গুলো বাদ দেয় সরকার। সেবছরই কয়েকটি শ্রমিক ও মানবাধিকার সংগঠন গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি নেটওয়ার্ক গঠন করে। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় নেটওয়ার্কটি ‘গৃহশ্রমিকের অধিকার সুরক্ষা ও কল্যাণ আচরণবিধি’র খসড়া তৈরি করে ২০০৯ সালের ৯ এপ্রিল মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। ওই আচরণবিধির আলোকে ২০১০ সালে প্রণীত হয় ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা’ খসড়া। যা আজও অনুমোদন করেনি সরকার।
এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী ও আইন ও শালিস কেন্দ্রের কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “মূলত: নীতি নির্ধারকদের গাফিলতিতেই দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালার অনুমোদন। তারা ইচ্ছে করেই সাবধানতার সঙ্গে এ বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চায়। কারণ, প্রত্যেকের বাসাতেই গৃহকর্মী আছে। প্রস্তাবিত নীতিমালা অনুমোদন হলে তাদের ওভারটাইম, বিনোদন, চিকিৎসাসহ নানা রকম সুবিধা দিতে হবে। এসব কারণে আন্দোলনকারীদেরও এ বিষয়টির প্রতি আগ্রহ কম।”
খসড়ায় যা বলা আছে
সেই খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, ১৪ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে গৃহকাজে নিয়োগ করা যাবে না। কোনো গৃহকর্মীকে তালাবদ্ধ করে রাখা যাবে না। তবে তার নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বাড়ি তালাবদ্ধ করতে হলেও একটি চাবি তার কাছে রাখতে হবে। বয়স ও সামর্থ্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্য বিবেচিত ভারী ও বিপজ্জনক কাজে কিশোর-কিশোরীদের নিয়োগ করা যাবে না।
এতে আরো বলা হয়েছে, দেশের সব সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর কার্যালয়, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ গৃহশ্রমিকদের নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবে। শিশু গৃহশ্রমিক নিয়োগে অভিভাবকের সঙ্গে এবং প্রাপ্তবয়স্ক হলে সেই ব্যক্তির সঙ্গে নিয়োগকর্তার চুক্তি থাকতে হবে। এ চুক্তিতে নিয়োগের ধরন, মজুরি, কর্মঘণ্টা, বিশ্রামের সময় ও ছুটি, লেখাপড়ার ব্যবস্থা, কাজের ধরন, থাকা-খাওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো উল্লেখ থাকবে।
নীতিমালায় গৃহকর্মীর ছবিসহ পরিচয়পত্র ও সপ্তাহে কমপক্ষে এক দিন ছুটির কথা বলা হয়েছে। গৃহকর্মী হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হলে সুবিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। গর্ভকালীন ও প্রসূতিকালীন সুবিধা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করার কথাও নীতিমালায় বলা আছে।
কেন্দ্র ছাড়াও জেলা, উপজেলা, সিটি করপোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদে নজরদারি করার জন্য বিশেষ কেন্দ্র গঠন করার কথা বলা হয়েছে। কেন্দ্রের তৈরি পরিদর্শন দল পরিস্থিতি বুঝতে বাড়ি বাড়ি যাবে। তবে নির্যাতন বা হয়রানির শিকার গৃহশ্রমিক ওই কেন্দ্রে, সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিত বা মৌখিক অভিযোগ জানাতে পারবে। একই সঙ্গে তারা ফৌজদারি মামলাও করতে পারবে।
শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট জাফরুল হাসান বেনারকে বলেন, “এই নীতিমালা হলে গৃহশ্রমিকদের অধিকারের বিষয়গুলো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাবে। ফলে নিবন্ধন, নিয়োগপত্র, মজুরি নির্ধারণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। তবে এটি আইন না হওয়ায় তার পালনে কাউকে বাধ্য করা যাবে না। তাই নীতিমালাতেই আবদ্ধ না থেকে গৃহশ্রমিকদের সুরক্ষায় আইন করাও জরুরি।”
সরকারের বক্তব্য
এদিকে গৃহশ্রমিক নীতিমালার বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতি মন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, “এ বিষয়টি নিয়ে সরকার যথেষ্ট আন্তরিক। ২০১০ সালে প্রণীত ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা’র খসড়া চূড়ান্ত করে তা বাস্তবায়ন করার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।”
এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলে থাকা জাতীয় পার্টি থেকে আসা এই প্রতিমন্ত্রী।
গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় ক্রিকেটার দম্পতির নামে মামলা
মারের চোটে প্রায় বুজে আসা দুই চোখ। চোখের নিচে গভীর ক্ষত। হাত-পাসহ সারা শরীরে অসংখ্য নির্যাতনের কালচে দাগ। অমানুষিক নির্যাতনে ভেঙে যাওয়া বাম পায়ে প্লাস্টার। আর এসব ক্ষত থেকে তৈরি হওয়া অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ছটফট করছে ১১ বছর বয়সী শিশু গৃহকর্মী মাহফুজা আক্তার হ্যাপি। বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন রাজিব ও তার স্ত্রী নিত্য শাহাদাতের নির্যাতনের শিকার এই শিশুটি। গত সোমবার ভোরে রাস্তা থেকে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ ।
এ ঘটনায় ক্রিকেটার শাহাদাত ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে শিশু নির্যাতন আইনে মামলা হয়েছে। তবে ঘটনার চারদিনেও আসামিদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
সামান্য ঘটনাতেই মারধরের অভিযোগ
হাসপাতালের বিছানায় বসে শিশু হ্যাপী জানায়, বাবা আরব আলী ও মা পেয়ারা বেগম অন্য জায়গায় বিয়ে করে চলে যাওয়ায় নানী মনোয়ারা বেগম প্রায় এক বছর আগে তাকে শাহাদাতের বাসায় কাজে দেয়। শুরুতে শাহাদাতের বাচ্চাকে দেখাশোনার কথা বলে কাজে নেওয়া হলেও সমস্ত কাজই করানো হতো তাকে দিয়ে। পান থেকে চুন খসলেই তাকে মারধর করতেন ওই ক্রিকেট দম্পতি। এমনকি গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিতেন তারা।
গত রোববার সকালেও তারা শিশুটিকে বাসায় আটকে রেখে নির্যাতন চালান। একসময় বাসার দরজা খোলা পেয়ে সে বাসা থেকে বের হয়ে যায় হ্যাপী। কালশী এলাকায় এসে অসুস্থ হয়ে পড়লে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে পুলিশের কাছে দেয়।
বৃহস্পতিবার ঢামেকের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) সমন্বয়কারী বিলকিস বেগম বেনারকে বলেন, হ্যাপীর চিকিৎসায় পাঁচ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। অর্থপেডিকস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর শামসুজ্জামান শাহীনের নেতৃত্বে গঠিত ওই বোর্ডে চক্ষু, শিশু সার্জারি, মানসিক ও নিওরো সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকরাও আছেন।
‘শাহাদাতকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না’
মামলার চারদিন পার হলেও শাহদাত কিংবা তাঁর স্ত্রীকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। এ বিষয়ে মিরপুর থানার ওসি (তদন্ত) শফিক আহমেদ বেনারকে বলেন, “সম্ভাব্য সকল স্থানে এই ক্রিকেট দম্পতির খোঁজ করা হচ্ছে। তবে এখনো তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে তারা দেশেই আছেন। পুলিশ তাদের আটকের চেষ্টা চালাচ্ছে”।
এদিকে গৃহকর্মীর সঙ্গে শাহাদাতের এমন আচরণে বিব্রত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিবি)।বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজামউদ্দিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “একজন সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে ওর কাছে এটা প্রত্যাশিত নয়। এটা বিব্রতকর বিষয়। আমরা বিব্রত। এটা শুধু ওর ভাবমূর্তির বিষয় না, বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সম্পর্কে বিশ্বের কাছে বাজে বার্তা যাচ্ছে।”
পুলিশের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ
মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বেনারকে বলেন, “একদিকে প্রভাবশালী ক্রিকেটার দম্পতি, অন্যদিকে হতদরিদ্র গৃহকর্মী। এ কারণেই মূলত পুলিশ অভিযুক্তদের আটকে অবহেলা করছে। গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনাগুলো এভাবেই প্রভাবশালীদের চাপে ঢাকা পড়ে যায়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়”।