দুই শিশু হত্যার দ্রুত বিচার, ৬ জনের মৃত্যুদন্ড

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.11.09
BD-child রায় শুনেই রাজনের বাবা আজিজুর রহমান কান্নায় ভেঙে পড়েন। ৮ নভেম্বর,২০১৫
বেনার নিউজ

হিংস্র, জঘন্য আর নিষ্ঠুরতার নির্মম বলি হওয়া দুই শিশু হত্যার দ্রুত বিচার করে ইতিহাসের অংশ হলো বাংলাদেশ। হত্যার প্রায় চার মাসের মধ্যেই এই দুই শিশু হত্যায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পেলো ছয় আসামি।  সকল মহল থেকে এ রায়কে দৃষ্টান্তমূলক আখ্যা দেওয়া হচ্ছে।

রোববার বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সিলেটের আদালত সবজি বিক্রেতা শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন (১৪) হত্যায় চারজন এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা খুলনার আদালত গ্যারেজ-কর্মী শিশু রাকিব (১২) হত্যায় দুইজনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। যেখানে দুই হত্যা মামলার একটিতে ১৭ বিচারিক কার্যদিবস ও অপরটিতে ১০ কার্যদিবস বিচার চলে।

এ দুই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম বেনারকে বলেছেন, রায় দুটি দ্রুত বিচার নিশ্চিতে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের জন্য এটা একটি মাইলফলক।

দুই শিশুর পরিবারও এ বিচারে জানিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

রাজন হত্যা মামলা: চলতি বছরের ৮ জুলাই চুরির অপবাদ দিয়ে সিলেটের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন শেখপাড়ায় পিটিয়ে হত্যা করা হয় জালালাবাদ থানার বাদেয়ালি গ্রামের শিশু রাজনকে। ঘটনার দৃশ্য ধারণ করে নির্যাতনকারীরা ভিডিও চিত্রটি ফেসবুকে প্রকাশ করেন। ১২ জুলাই ভিডিও চিত্র নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

এই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে জালালাবাদ থানায় মামলা করে। ১৬ আগস্ট ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ঘটনার পরপরই সৌদি আরবে পালিয়ে যায় নির্মম ঘটনার প্রধান কারিগর কামরুল। পরে বিচার চলাকালীন সময় আসামি কামরুলকে সৌদি কর্তৃপক্ষের সহায়তায় গত ১৫ অক্টোবর ফিরিয়ে আনা হয়।

এদিকে গত ৭ সেপ্টেম্বর মামলাটি বিচারের জন্য মুখ্য হাকিম আদালত থেকে মহানগর দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তরিত করা হয়। পরে ১ থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র ১৭ কার্যদিবসে মামলার বিচার-প্রক্রিয়া শেষ হয়।

এরপর ৮ নভেম্বর রোববার ১৩ আসামির মধ্যে ১১ আসামির উপস্থিতিতে রায় ঘোষনা করনে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আকবর হোসেন মৃধা।

রায় ঘোষণাকালে রাজনের বাবা মাইক্রোবাসচালক শেখ আজিজুর রহমান, মা লুবনা আক্তারসহ পরিবারের সদস্য এবং বিপুল সংখ্যক গ্রামবাসী আদালতপাড়ায় উপস্থিত ছিলেন। রায় শুনেই রাজনের বাবা-মা কান্নায় ভেঙে পড়েন।

দন্ডপ্রাপ্ত যারা

রায়ে প্রধান আসামি কামরুল ইসলামসহ চারজনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। কামরুল ছাড়া বাকীরা হচ্ছেন, জালালাবাদ থানা এলাকার পীরপুর গ্রামের বাসিন্দা, সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডের চৌকিদার সাদেক আহমদ ওরফে বড় ময়না (৩৫), শেখপাড়া গ্রামের তাজউদ্দিন আহমদ ওরফে বাদল (২৪) ও সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ঘাগটিয়া গ্রামের জাকির হোসেন ওরফে পাবেল ওরফে রাজু মিয়া (২০)। এর মধ্যে জাকির হোসেন পলাতক রয়েছেন।

এই মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ পাওয়া ব্যক্তি হলেন জালালাবাদ থানা এলাকার জাঙ্গাইল গ্রামের বাসিন্দা ঘটনার ভিডিও চিত্র ধারণকারী নূর আহমদ ওরফে নূর মিয়া (২০)। যাবজ্জীন কারাদণ্ডের পাশাপাশি তাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে দুই মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত।

সাত বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে প্রধান আসামি কামরুলের তিন ভাই মুহিত আলম, আলী হায়দার ওরফে আলী ও শামীম আহমদকে(পলাতক)। এ ছাড়া ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দুলাল আহমদ ও আয়াজ আলীকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়।

তবে এ মামলায় প্রত্যক্ষদর্শী ফিরোজ আলী, আজমত উল্লাহ ও রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তারা বেকসুর খালাস পেয়েছেন।

রায় ঘোষণার পরে স্থানীয় আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মফুর আলী বলেন, রায় ঘোষণার সময় আদালত দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সাত দিনের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপিল করার নির্দেশনা দিয়েছেন।

তবে ন্যায়বিচার না পাওয়ার অভিযোগ এনে উচ্চ আদালতে আপিল করার কথা জানিয়েছে আসামিপক্ষের আইনজীবী হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, “হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল না। তাই আসামিরা উচ্চ আদালতে জামিন আবেদন করবেন।”


রাকিব হত্যা

গত ৩ আগস্ট বিকেলে খুলনার টুটপাড়ায় শরীফ মোটরস নামের গ্যারেজে কাজ না করার অভিযোগে মোটরসাইকেলের চাকায় হাওয়া দেওয়ায় ব্যবহৃত কমপ্রেসর মেশিনের নল রাকিবের মলদ্বারে দিয়ে শরীরে বাতাস ঢোকানো হয়। এতে সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং ওই দিন রাত ১০টার দিকে মারা যায়।

এ হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে শরীফ মোটরসের মালিক শরীফ, তার সহযোগী মিন্টু ছাড়াও শরীফের মা বিউটি বেগমকে জনতা গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছিল।

হত্যাকাণ্ডের পরদিন রাকিবের বাবা মো. নুরুল আলম এ তিনজনের বিরুদ্ধে খুলনা সদর থানায় হত্যা মামলা করেন। রোববার সে মামলার বিচার কার‌্যক্রম শেষে শিশু রাকিব (১২) হত্যার ঘটনায় প্রধান দুই আসামি মো. শরীফ ও মিন্টু খানের মৃত্যদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক দিলরুবা সুলতানা। তবে অপর আসামি বিউটি বেগমকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। বিউটি বেগমকে বেকসুর খালাস দেওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন রাকিবের স্বজন ও গ্রামবাসীরা। তারা বিউটিকে বহনকারী প্রিজন ভ্যানটি আটকানোর চেষ্টাও করেন।


যা বলেছে আদালত

আদালতের রায়ে বলা হয়, আসামিরা অভিনব কৌশলে যে মারাত্মক অস্ত্র দিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, তা নিষ্ঠুরতার চরমতম উদাহরণ বলে বিবেচিত। বাংলা ভাষায় নিষ্ঠুরতার যত সমার্থক শব্দ আছে, তার সব এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে। আসামিপক্ষের দাবি, ইয়ার্কি করতে গিয়ে কাজটি ঘটে গেছে। তাদের ইয়ার্কির বলি কখনোই একজন শিশু হতে পারে না। কথিত এ ধরনের ইয়ার্কি জঘন্য ও নিষ্ঠুরতম।

এদিকে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বাদীপক্ষের আইনজীবী মোমিনুল ইসলাম বলেন, রায়ে আমরা খুশি।

তবে  আসামিপক্ষের আইনজীবী তৌহিদুর রহমান চৌধুরী এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দেন।


দ্রুত রায় কার্যকর চায় নিহত শিশুদের পরিবার

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে এসব রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছে নিহত শিশু দুটির পরিবার।
রাজনের বাবা আজিজুর রহমান বেনারকে বলেন, আমি দ্রুত রায় কার্যকর দেখতে চাই। তবে রায় কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত সকলের সহযোগিতাও কামনা করছি।

এছাড়া আসামিদের পরিবারের হুমকি-ধামকিতে বেশ অনিরাপদও বোধ করছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

রাকিবের বাবা নুরুল ইসলামও দ্রুত এই রায় কার্যকর দেখতে চেয়ে বলেন, “এ রায় যেন উচ্চ আদালতেও বহাল থাকে। না হলে তারা বের হয়ে এসে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে। এখন একটাই চাওয়া, রায় যেন দ্রুত কার্যকর হয়।”

তবে রাকিব হত্যা মামলা থেকে বিউটি বেগমকে খালাস অসন্তোষ প্রকাশ করে শিশুটির মা লাকি বেগম বলেন, “রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। তবে বিউটি বেগমের সাজা না হওয়ায় নিরাপত্তাহীনতায় থাকব। তার শাস্তি হওয়া দরকার ছিল।”


‘বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা বাড়বে’

মানবাধিকার কর্মী ও বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বেনারকে বলেন, অত্যন্ত দ্রুততম সময়ে রাকিব ও রাজন হত্যার মামলার রায় দিয়ে ইতিহাস গড়েছে আদালত। এভাবে সব মামলার দ্রুত বিচার সম্পন্ন হলে দেশে অপরাধের মাত্রা অনেক কমে আসবে। বিচারব্যবস্থার প্রতিও মানুষের আস্থা বাড়বে।”


সরকারদলীয় সাংসদ লিটনের জামিন মঞ্জুর

এদিকে দুই শিশু হত্যার রায়ে যেদিন সর্বোচ্চ সাজা ঘোষণা করা হল, একই দিনে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা গাইবান্ধায় আরেক শিশুকে গুলি করে আহত করার মামলায় জামিন পেয়েছেন সরকার দলীয় সাংসদ মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। সংসদ অধিবেশন যোগ দিতে জামিন করার পর গাইবান্ধার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত তাকে জামিন দেন।

এরপর ২৪ দিন কারাবাসের পর আদলতের আদেশে ছাড়া পান লিটন।

জামিন আবেদনের শুনানিতে সাংসদের আইনজীবী আদালতকে বলেন, এখন সংসদ অধিবেশন চলছে। সাংসদ মঞ্জুরুল ইসলামের অধিবেশনে উপস্থিত থাকা জরুরি। তবে রাষ্ট্রপক্ষে কৌঁসুলিরা জামিনের বিরোধিতা করেন।  

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।