‘নৈতিকতা’র প্রশ্নে বিদ্ধ নয়া মেয়ররা
2015.04.29

নির্বাচনে জিতেও শেষমেষ নৈতিকতার প্রশ্নে জর্জরিত বাংলাদেশের সদ্য বিজয়ী তিন সিটি কর্পোরেশনের মেয়র। ব্যাপক কারচুপি আর অনিয়মের অভিযোগ তাদেরকে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে।
শীঘ্রই নগরের দায়িত্ব নিতে যাওয়া এসব নগর পিতারা নির্বাচনে জিতলেও রাজনৈতিক এবং নৈতিকতার মাপকাঠিতে হেরেছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আর ভোটাদের অভিযোগ ভো্টাধিকারের নামে প্রতারিত হয়েছেন তারা।
তবে বিজয়ীরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
গত ২৮ এপিল ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। তিনটিতেই জয়ী হয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী। এরা হলেন- ঢাকা উত্তরে আনিসুল হক ও দক্ষিণে সাঈদ খোকন এবং চট্টগ্রামে আ জ ম নাছির উদ্দিন।
তবে নির্বাচনের পরদিনই নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল ইলেকশন ওয়ার্কিং (ইডব্লিউজি) গ্রুপ বলছে ‘বিশ্বাসযোগ্য হয়নি’ এ নির্বাচন। উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অনিয়ম ও সহিংসতার অভিযোগ এনেছে তারা।
মুখ বন্ধ করে থাকেনি আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। এ সংস্থার বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, ‘যেভাবে নির্বাচন হয়েছে তা অবশ্যই বিরাটভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। যে তিনজন মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন বলে দাবি করছেন, নৈতিক এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় দুভাবেই তাদের অবস্থান দূর্বল। যতদিন এ পদে থাকবেন এ দূর্বলতার ভার ততদিনই তাদের বয়ে বেড়াতে হবে।’
মঙ্গলবারের এ নির্বাচনে বহু ভোটার ভোট দিতে না পেরে ফিরে যান। তারাও প্রশ্ন তুলেছেন বিজয়ী মেয়রদের নিয়ে। নির্বাচন প্রক্রিয়া আর স্বচ্ছতা নিয়ে।
এমনই একজন জুরাইনের ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার নাইম সিদ্দিক অর্ণব। তিনি বেনারকে বলেন, ‘গতকাল ভোট দিতে গিয়েও পারিনি। কারণ আমার ভোট আগেই কেউ দিয়ে দিয়েছে। আমি মনে করি, যারা নির্বাচিত হয়েছেন এবং যেভাবে নির্বাচন হয়েছেন তা প্রশ্নবিদ্ধ। ভোটের নামে আমাকে, সাধারণ মানুষকে ঠকানো হয়েছে। কিন্তু এসব জেনেও মেনে নেয়া ছাড়া আমাদের যেন কিছুই করার নেই।’
তিনি বলেন, এসকল প্রার্থী নির্বাচনি প্রচারণায় সততার কথা বলেছেন। সংস্কৃতি বদলানোর কথা বলেছেন। কিন্তু এমন ভোট জালিয়াতি করে যারা ক্ষমতায় গেছেন, তাদেরকে কিভাবে সৎ বলে মেনে নেব। জনগণের চোখে তারা এখনই অনেক নিচে নেমে গেছেন।
‘সিটি করপোরেশন নির্বাচন নাগরিক অধিকার প্রয়োগের একটি দিক ছিল। কিন্তু নাগরিককে সে অধিকার দেওয়া হয়নি’-বলে বেনারকে বলেন জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ।
এদিকে এসকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সদ্য জয়ী নগর পিতারা। তাদের দাবি, জনগণ স্বতস্ফুর্ত ভাবেই তাদেরকে নির্বাচিত করেছে। এ বিজয়কে নৈতিক বা রাজনৈতিক পরাজয় নয় বরং জনতার রায়ের প্রতিফলন বলছেন তারা। তাই জনগণের সেবার মধ্য দিয়েই সে ঋণ শোধের অঙ্গীকার তাদের মুখে।
জয়ী ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বেনারকে ঢাকা দক্ষিণের জয়ী প্রার্থী সাঈদ খোকন বলেন, ‘এ নগরবাসী ভোট দিয়েই আমাকে নির্বাচিত করেছেন। আমি নগরের পিতা নই, সন্তান। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নগরবাসীর সেবাকেন্দ্র হিসেবে থাকবে। আমি ঢাকার জনতার মেয়র।’
চট্টগ্রামের জয়ী মেয়র প্রার্থী আ জ ম নাছির বলেছেন ‘জনগণের তাদের কাতারের মানুষ হিসেবে আমাকে নির্বাচিত করেছে। তাদের উন্নয়নে নিজেকে বিলিয়ে দেব।’
বুধবার সাঈদ খোকন, আনিসুল হক ও আ জ ম নাছিরকে সরকারিভাবে বিজয়ী ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। নিয়ম অনুযায়ী দুদিনের মধ্যেই গেজেট প্রকাশ করবে তারা। এরপর স্থাণীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাদের সুবিধামত সময়ে তিন মেয়রের শপথ অনুষ্ঠান আয়োজন করবে।
এদিকে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভোট বর্জন করে। সাধারণ মানুষ এ ঘটনায় সরকারের পাশাপাশি বিরোধী পক্ষের উপরেও আস্থা হারাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে বেনারকে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা বলেন, সরকার ও বিএনপি কোন পক্ষই জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি। নির্বাচনে সরকার দলীয় লোকজন অনিয়ম করেছে। প্রশাসনের যথেচ্ছা ব্যবহার করেছে। আর নির্বাচন বর্জন করে সাধারণ মানুষকে আরো হতাশায় ফেলে দিয়েছে বিএনপি। তাদের উচিত ছিল জনগণের সামনে জালিয়াতির বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা।
গত বছর ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। দলটি এ বছর টানা কয়েক মাস ধরে সহিংস আন্দোলন চালায়। এরপর সিটি কর্পোরেশনে দলটির অংশগ্রহণ রাজনীতিতে কিছুটা নমনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে। কিন্তু এমন ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের পরে কতটা নমনীয় থাকবে রাজনীতি, সেটা নিয়েও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এখনো বিএনপি কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করেনি।
এ প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচন শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। এর ফলে দেশে আবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হতে পারে, যা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে নয়।
এ প্রসঙ্গে ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনীতি থেকে উত্তরণে যে ইতিবাচক সুযোগের সৃষ্টি হয়েছিল, মঙ্গলবারের তিনটি সিটি নির্বাচনই সামগ্রিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির ঝুঁকি পুনরায় সৃষ্টি হয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর পর ঢাকা ও চট্টগ্রামের অন্য মেয়র প্রার্থীরাও দুপুরের আগে ও পরে ভোট বর্জন করেন।