এগোনোর পথ পাচ্ছে না বিএনপি
2015.04.29

ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিরোধী দল বিএনপি এখন আর সামনে এগোনোর পথ পাচ্ছে না। সরকারের রাজনৈতিক ফাঁদে পা দিতে দিতে দলটি আটকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
বিএনপির নেতারাই এখন বলতে শুরু করেছেন, জনপ্রিয়তা যে শুধু একটি রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে নিতে পারে না, তার বড় প্রমাণ এই দলটি। নেতৃত্বের সঙ্কট ও নেতা–কর্মীদের মনোবল নষ্ট হওয়ায় দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা দলটি এক ধরণের অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
“আসলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে যাঁরা বিশ্বাস করে, তারাই রাজনীতিতে টিকে থাকবে, বাকিরা ছিটকে পড়বে। শুধু ক্ষমতার রাজনীতি যারা করবে তারা প্রকৃতির নিয়মেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক,” বেনারকে জানান সব্যসাচি লেখক সৈয়দ শামসুল হক।
লেখক হিসেবে পরিচিত হলেও সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে সরকার–সমর্থক নবগঠিত নাগরিক সংগঠন সহস্র নাগরিক কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন সৈয়দ হক ।তাঁর মতে, ক্ষমতার বলয় বা সেনাছাউনি থেকে জন্ম হওয়ায় বিএনপি সত্যিকার রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠেনি।
‘জিতলেও লাভ, হারলেও লাভ’-এমন একটি সমীকরণ সামনে রেখে ‘আন্দোলনের অংশ হিসেবে’ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে টানা তিন মাসের আন্দোলনে ছেদ টেনে হঠাৎ সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রশ্নে দলটিতে দ্বিধাদ্বন্দ ছিল।
তবে বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের চাপাচাপিতে দলটি নির্বাচনের মাঠে আসে বলেও রাজনৈতিক গুঞ্জন রয়েছে।
“আমরা ম্যাডামকে নির্বাচনে আসতে অনুরোধ করেছি, এটা সত্য। তার মানে এই নয় যে তিনি নির্বাচনের বিপক্ষে ছিলেন,” বেনারকে জানান বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবী আ ফ ম ইউসুফ হায়দার, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বিএনপি–জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ–উপাচার্য ছিলেন।
নির্বাচনের একদিন আগে সংবাদ সম্মেলনে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি নির্বাচনকে সরকার, শাসক দল, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে নিয়েছে বিএনপি।
স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনেও যদি সন্ত্রাস, ডাকাতি, কারচুপির মাধ্যমে সরকার জনগণের রায় বদলে ফেলে, তাহলে আবারও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে যে এদের অধীনে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তা সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অবান্তর।
“আমরা জানতাম এমনই হবে। তারপরও কেউ যাতে বলতে না পারে বিএনপি নির্বাচন বিমুখ দল, এ জন্যই আমরা নির্বাচনে গিয়েছি। এখনতো দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল,” বেনারকে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান।
তবে ভোটের দিনদুপুরেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়ায় বিএনপির রাজনৈতিক দুরদর্শীতা ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রাজধানীতে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থাও খোলাসা হয়েছে। ভোটের একদিন আগে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ভোটকেন্দ্রে পাহারা বসাতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, গণনা শেষে ফলাফল বুঝে নিয়ে কেন্দ্র ত্যাগ করতে।
সরেজমিন দেখা গেছে, বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। নির্বাচনের দিন বেশির ভাগ কেন্দ্রে বিএনপি এজেন্ট রাখতে পারেনি। নেতা-কর্মীরা নির্বাচনী মাঠে ছিলেন না। গ্রেপ্তার আতঙ্কে প্রায় সবাই ছিলেন চুপচাপ।
নির্বাচন সমন্বয়ে যুক্ত নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, বিএনপির নেতা-কর্মীরা যদি মাঠে থাকতেন তাহলে পরিস্থিতি অন্য রকম হত পারত।
“এতবড় একটি নির্বাচনে বড় কোনও মারামারি হয়নি, হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো এজেন্ট নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেনি। এভাবে বিরোধীদলের অবস্থান দুর্বল হলে গণতন্ত্রও দুর্বল হবে, বেনারকে জানান ইকবাল সোবহান চৌধুরী, যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য উপদেষ্টা।
তবে বিএনপির নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, এই নির্বাচনে বিএনপি হারেনি, যা হারার সরকারই হেরেছে। সরকারের ভাবমূর্তি দেশে-বিদেশে আবারও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। নির্বাচন কমিশন ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’-প্রমাণিত হয়েছে।
দলটির একাধিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ধারনা পাওযা যায়, এ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ‘পাকাপোক্ত’ হয়েছে।এটিও প্রমাণ হয়েছে সাংগঠনিকভাবে বিএনপি এখন খুবই দুর্বল। বিএনপির পক্ষে জনমত থাকলেও আবার সরকার বিরোধী শক্ত আন্দোলন দাঁড় করানোর পরিস্থিতি নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির ওইসব নেতা বলেন, নেতা-কর্মীদের মধ্যে তাঁরা হতাশা দেখেছেন। এই অবস্থায় এখন হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে যাওয়া দলের জন্য ঠিক হবে না। বরং দলকে আবার সংগঠিত করে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
“দেশের ইতিহাসে যত স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়েছে, সে নিরিখে এটা কোনো নির্বাচনই না। ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনকেও এটি হার মানিয়েছে ,” বেনারকে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ।
বিএনপির এসব অভিযোগের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বলেছেন, বিপুলসংখ্যক ভোটারের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু পরিবেশে গতকালের সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা জানায়, বুধবার তেজগাঁওয়ে নিজের কার্যালয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ৩ মাসের অবরোধ ও হরতালে নিহত ব্যক্তিদের স্বজন এবং আহত ব্যক্তি ও ক্ষতিগ্রস্ত বাস মালিকদের মাঝে চেক বিতরণকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশের মানুষ কখনো বিএনপির মতো একটি কুৎসিত দলকে ভোট দেবে না। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে দেশবাসী বিএনপিকে গতকালের সিটি নির্বাচনের মতো প্রত্যাখ্যান করবে।
তবে ব্যাপক অনিয়ম, কারচুপি, বিএনপির বর্জন, মাঠে না থাকার পরও দল-সমর্থিত প্রার্থীরা বিপুল ভোট পেয়েছেন। ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হকের চার লাখ ৬০ হাজার ১১৭ ভোটের বিপরীতে বিএনপি-সমর্থিত তাবিথ আউয়াল পেয়েছেন তিন লাখ ২৫ হাজার ৮০ ভোট।
ঢাকা দক্ষিণে সাঈদ খোকনের পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোটের বিপরীতে বিএনপি-সমর্থিত মির্জা আব্বাস পেয়েছেন দুই লাখ ৯৪ হাজার ২৯১ ভোট।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বিএনপি-সমর্থিত মনজুর আলম পেয়েছেন তিন লাখ ৪ হাজার ৮৩৭ ভোট।চার লাখ ৭৫ হাজার ৩৬১ ভোট পেয়ে মেয়র পদে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিন।
বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, সরকার নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য দেখাতে ‘দয়া করে’ বিএনপির প্রার্থীদের কিছু ভোট দিয়েছে।
“বিএনপির বেশির ভাগ নেতা-কর্মী পরিস্থিতি দেখে ১০টার পর কেন্দ্রেই যাননি। তাই এত ভোট পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। বরং বিরোধীদের কিছু ভোট দেওয়া হয়েছে বলে ধারনা করা যায়,” বেনারকে জানান তাবিথ আউয়ালের অন্যতম গণমাধ্যম সমন্বয়কারি ইলিয়াস খান, যিনি বর্তমান সরকারের সময়ে বন্ধ হওয়া আমার দেশ পত্রিকার ক্রিড়া সম্পাদক ছিলেন।
সিটি নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের ঠেকাতে নির্বাচনে পুলিশ, র্যাবসহ রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার ও ভোটকেন্দ্রে সরকার-দলীয় নেতা-কর্মীদের শক্তি প্রয়োগের ঘটনা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনকেও ছাড়িয়ে গেছে।
তবে এ অবস্থায় বিএনপি ধীরেসুস্থে আন্দোলনে নামতে চায়। এখনই হরতালের মতো কর্মসূচি দিতে চায় না দলটি।
“সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলাম, পুলিশ ও র্যাবের সহযোগিতায় নির্বাচন কমিশন নীলনকশার নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। এ-ও বলেছিলাম, কালই এর সত্যতা দেখব। ঢাকাবাসী, দেশবাসী ও বিশ্ববাসী তাই দেখেছে,” বেনারকে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ।