দুর্নীতি মামলায় ঢাকার সাবেক মেয়র খোকার ১৩ বছরের কারাদন্ড
2015.10.20

একটি দুর্নীতির মামলায় বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকাকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। সম্পত্তির তথ্য গোপন ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মঙ্গলবার ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালত সাত বছর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা এই মামলার রায় ঘোষণা করেন।
‘চিকিৎসার জন্য’ বর্তমানে নিউইয়র্কে অবস্থান করা ঢাকার এই সাবেক মেয়রকে সাজার পাশাপাশি ১১ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। এছাড়া অবৈধভাবে তিনি ১০ কোটি ৫ লাখ ২১ হাজার ৮৩২ টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন ঘোষণা করে, ওই সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে খোকার বিরুদ্ধে এই প্রথম দুর্নীতির কোন মামলায় রায় হলো; যেখানে তাকে পলাতক দেখিয়ে বিচার চলে।
খোকা পলাতক থাকায় তার আত্মসমর্পণের তারিখ বা গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করার তারিখ থেকে দণ্ডভোগের মেয়াদ ধরা হবে। খোকার বিরুদ্ধে দণ্ড পরোয়ানা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
‘ন্যায় বিচার বঞ্চিত’ দাবি আসামিপক্ষের
এদিকে খোকা ন্যায় বিচার পাননি বলে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় অভিযোগ করেছেন তার আইনজীবী। তবে বাদি পক্ষের দাবি, তারা আদালতে আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছেন।
আসামি সাদেক হোসেন খোকার আইনজীবী মহসিন মিয়া বেনারকে বলেন, “খোকা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।”
তবে দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, “আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত এই রায় দিয়েছে।”
বিএনপির প্রতিক্রিয়া
এদিকে দুর্নীতির মামলায় দলের ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার কারাদণ্ডাদেশ ‘ন্যায়বিচারের পরিপন্থি’ বলে জানিয়েছে বিএনপি।
মঙ্গলবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলটির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, “দণ্ডাদেশ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সাদেক হোসেন খোকাকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এ রায়ে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তিনি।”
বিএনপির মুখপাত্র বলেন, “দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা এই মামলায় তাকে পলাতক দেখিয়ে বিচার হলেও প্রকৃতপক্ষে খোকা উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় কিডনির ক্যান্সারের উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন এবং সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এমতাবস্থায় নিম্ন আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শুরুটাই ছিল আইনবহির্ভূত। একতরফা এ বিচারের নামে প্রহসন করে যে দণ্ড দেওয়া হয়েছে, তা আইন-বিচারের ইতিহাসে বাজে নজির হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। উচ্চ আদালতের অনুমতি নিয়ে বিদেশে থাকা ব্যক্তিকে পলাতক ঘোষণা বেআইনি।”
রায়ে যা বলা হয়
আদালতের রায়ে বলা হয়, আসামি খোকা অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ার পাশাপাশি নয় কোটি ৬৫ লাখ তিন হাজার টাকার সম্পদের ওপর প্রযোজ্য কর ফাঁকি দিয়েছেন।
রায়ে দুদক আইনের ২৬ এর ২ ধারা অনুযায়ী ‘মিথ্যা তথ্য দেওয়ায় কারণে’ খোকাকে তিন বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা জরিমানা করেছে আদালত। ওই টাকা দিতে না পারলে তাকে আরও এক মাস জেল খাটতে হবে।
আর অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ায় ২৭ এর ১ ধারা অনুযায়ী খোকার ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের রায় হয়েছে। পাশাপাশি তাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন বিচারক। জরিমানার টাকা দিতে না পারলে ভোগ করতে হবে আরও ৬ মাসের সাজা।
দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, “আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, সাদেক হোসেন খোকা সাবেক মন্ত্রী, সাংসদ ও মেয়রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে এলেও অবৈধ সম্পদ রেখে অপরাধ করেছেন। আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হলেও তা করেননি। তার প্রতি নমনীয় হওয়ার সুযোগ নেই।”
বাদ পড়ে স্ত্রী সন্তান, স্থগিতাদেশ পান স্ত্রী
গত ২০০৮ সালের ২ এপ্রিল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সহকারী পরিচালক শামসুল আলম রমনা থানায় মামলাটি করেন। ঢাকার সাবেক মেয়র খোকার পাশাপাশি তার স্ত্রী ইসমত আরা এবং ছেলে ইসরাক হোসেন ও মেয়ে সারিকা সাদেককেও মামলায় আসামি করা হয়। তবে একই বছর ১ জুলাই দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা খোকার ছেলে ও মেয়ের নাম বাদ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। আর অভিযোগপত্র হওয়ার আগেই ইসমত আরা হাই কোর্টে গিয়ে তার বিরুদ্ধে এ মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ পান।
এরপর ২০১৪ সালের ৩০ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলায় খোকার বিচার শুরু হয়। অবশ্য তার মাস ছয়েক আগেই তিনি চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান।
এ মামলায় দুদকের পক্ষে ৪৩ জন সাক্ষীর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ ৪০ জনকে আদালতে উপস্থিত করে। তবে আদালতের দৃষ্টিতে পলাতক থাকায় সাক্ষীদের জেরা করার সুযোগ পাননি খোকার আইনজীবী।
বাজেয়াপ্ত হবে যেসব সম্পদ
রায়ে যে ১০ কোটি পাঁচ লাখ ২১ হাজার ৮৩২ টাকা মূল্যের স্থাবর-অস্থাবর যেসব সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে খোকার মালিকানাধীন গুলশান ২ নম্বর সেক্টরের ৭২ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর হোল্ডিংয়ের পাঁচ কাঠা জমি এবং তার উপর ছয়তলা ভবনও রয়েছে, যার দাম দুই কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
মেসার্স বুড়িগঙ্গা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বিভিন্ন মৌজায় ২৭ খণ্ড কৃষিজমি, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন মৌজায় ৩৪ খণ্ড কৃষিজমিসহ মোট ৬১টি দলিলে ১৩৩.৫৯৫২ একর জমি রয়েছে। এসব জমির চার মালিকের মধ্যে খোকার অংশ হিসেবে সাত কোটি ৩৪ লাখ ৪৮ হাজার টাকা দামের ১০০.১৯৪৬ একর জমি বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
এছাড়া বুড়িগঙ্গা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে হাবিব ব্যাংকে জমা করা টাকা থেকে ২৩ লাখ ১২ হাজার ৯৭৩ টাকা নিয়ে মোট ১০ কোটি পাঁচ লাখ ২১ হাজার ৮৩২ টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।