চামড়ার দাম কমিয়েছে ব্যবসায়ীরা, পাচার ঠেকাতে প্রস্তুতি
2015.09.23

গত অর্থবছরে বাংলাদেশ চামড়াজাত বিভিন্ন পণ্য ও পাদুকা রফতানি করে প্রায় ৫০ কোটি ডলার আয় করেছে। সবকিছুর দাম বাড়লেও বছর বছর কমছে কেবল কোরবানির পশুর চামড়ার দাম। এবার গরুর চামড়ার দাম বর্গফুট প্রতি কমপক্ষে ২০ টাকা কম ধরা হয়েছে।
গত বছর প্রতি বর্গফুট চামড়ার নির্ধারিত দাম ছিলো ৭০-৭৫ টাকা, তার আগের বছর ৮৫-৯০ টাকা, আর এবার দাম ধার্য করা হয়েছে ৫০-৫৫ টাকা।
গত বছরের তুলনায় এবছর গরুর চামড়ার দর দাম কমে যাওয়ার কারণ হিসাবে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম কমে যাওয়ার অজুহাত দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এতে এতিম ও দুস্থদের প্রাপ্য ভীষণভাবে কমে যাবে বলে কোরবানিদাতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
“আমরা কোরবানীর পশুর চামড়া মাদ্রাসা, মসজিদ বা এতিমখানায় দান করি। তাই এই ক্ষতি তাদের, যারা সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ,” বেনারকে জানান বাগেরহাট শহরের ইট-বালু ব্যবসায়ী হাওলাদার আলী আজম।
এবার সমিতি নির্ধারিত চামড়ার দাম গত বছরের চেয়ে কম হওয়ায় ভারতে চামড়া পাচার বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন ব্যবসায়ীরা।
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে বুধবার কোরবানি পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার অ্যান্ড ফুটওয়ার এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএলএলএফইএ)।
বিএফএলএলএফইএ সভাপতি আবু তাহের বলেন, “বিশ্ববাজারে এক বছরে ফিনিশড লেদারের দাম যত শতাংশ কমেছে, এবার তত শতাংশ কমিয়ে কোরবানির চামড়া সংগ্রহের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।” তাঁর দাবি, গত এক বছরে বিশ্বে চামড়ার দাম ৩০ শতাংশ কমেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, এবার কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করতে চাননি তাঁরা। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে তা করা হয়েছে।
শাহীন আহমেদ বলেন, গত বছর ভালো ও মাঝারি মানের ক্রাস্ট ও ফিনিশড লেদারের দাম ছিল গড়ে দুই ডলার। এবছর তা দেড় ডলারে নেমেছে। এই হিসেবে ক্রাস্ট ও ফিনিশড লেদারের দাম কমেছে ৩২ থেকে ৩৫ শতাংশ। সে অনুযায়ীই এবার চামড়ার দাম কমানো হয়েছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান মতে, দেশে চামড়াশিল্পে প্রতিবছর বাড়ছে রফতানি প্রবৃদ্ধি। ক্রাস্ট চামড়া রফতানির পাশাপাশি প্রতিবছর চামড়াজাত পণ্য জুতা, স্যান্ডেল, বেল্ট, ব্যাগ প্রভৃতি জিনিসের রফতানি বেড়ে যাচ্ছে।
তথ্যানুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৮ কোটি ডলারের চামড়ার পাদুকা রফতানি করেছে বাংলাদেশ। এ আয় তার আগেরবারের তুলনায় ২৭ দশমিক ৮১ শতাংশ বেশি।
শুধু তাই নয়, চলতি বছরের প্রথম সাত (জানুয়ারি-জুলাই) মাসে ৪ কোটি ১২ লাখ ৭৪ হাজার মার্কিন ডলারের পাদুকা রফতানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। এ আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেশি।
বছর বছর দাম কমছে
ঘোষিত দাম অনুযায়ী, গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়া ঢাকায় ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় কেনার ঘোষণা দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ঢাকার বাইরে গরুর চামড়া ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় আর খাসির প্রতি বর্গফুট চামড়া ২০ থেকে ২২ টাকা, বকরির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকায় কেনার কথা জানিয়েছেন তারা।
এছাড়া প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত মহিষের চামড়ার দাম ধরা হয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। মহিষের চামড়ার দাম এ বছরও একই রয়েছে।
গত বছর এই নির্ধারিত দাম ছিল লবন দেওয়া গরুর চামড়া ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। ঢাকার বাইরে গরুর চামড়ার দর ছিল প্রতি বর্গফুট ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। আর খাসির চামড়া ৩০ থেকে ৩৫ টাকা এবং বকরির চামড়া ২৫ থেকে ৩০ টাকা দর দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা।
২০১৩ সালেও চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। সে বছর ব্যবসায়ীরা ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়া কেনেন ৮৫ থেকে ৯০ টাকায় আর ঢাকার বাইরে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় কিনেছিলেন। ওই বছর প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়ার দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা আর বকরির চামড়া ৪০-৪৫ টাকা দাম বেধে দেওয়া হয়েছিলো।
“পচনশীল হওয়ায় এর দাম নির্ধারণ নিয়ে কারসাজি করার সুযোগ নেই, ” বেনারকে জানান কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আফতাব খান।
তার দাবি, গত বছরের অনেক চামড়া এখনও বিক্রি হয়নি, মজুদ রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও চামড়ার দাম গত বছরের চেয়ে কমেছে।
“চামড়ার টাকা গরীবের হক। দাম কমিয়ে দেওয়ায় গরীব দুস্থ এতিমদের বঞ্চিত করা হবে, ” বেনারকে জানান ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী।
তিনি চামড়া ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, তারা নানা অজুহাতে সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা ও প্রণোদনা নেয়। চামড়া কেনার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। কিন্তু, ব্যাংক ঋণও ঠিকমতো পরিশোধ করে না। সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমায়। আবার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া কিনে সে টাকাও ঠিকমতো দেয় না।
তিনি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি দেওয়া উচিৎ। তাহলে চামড়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে।
পাচার ঠেকাতে প্রস্তুতি
ব্যাপকহারে এবার চামড়া পাচার হতে পারে- ব্যবসায়ীদের এমন আশঙ্কার প্রেক্ষাপটে চিহ্নিত এলাকাগুলোতে সীমান্তরক্ষীদের পাশাপাশি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পুলিশ ও র্যাব।
ঢাকার পর দেশে পশুর চামড়ার সবচেয়ে বড় মোকাম যশোরের রাজারহাট। সেখানে দুই শতাধিক আড়তে ২১ জেলার ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করছেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ মোকামের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ১০ হাজার মানুষ।
“প্রতি কোরবানির ঈদে রাজারহাটে প্রায় ২০ কোটি টাকার চামড়া কেনাবেচা হয়,” বেনারকে জানান বৃহত্তর যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন মুকুল।
ঈদের পর সীমান্ত পথে চামড়া পাচার বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
পুলিশের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, চামড়ার ট্রাক ঢাকায় ঢুকতে পারবে। তবে চামড়া বোঝাই কোনো ট্রাক ঢাকা থেকে বের হতে দেবে না পুলিশ। ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে পুলিশ সতর্ক থাকবে।
যশোরের শার্শা উপজেলার শিকারপুর, কাশিপুর, বেনাপোলের পুটখালি, দৌলতপুর ও গোগা সীমান্তকে কোরবানির পশুর ‘চামড়া পাচারের রুট’ হিসাবে চিহ্নিত করে বাড়তি সতর্কতা নিয়েছে বিজিবি।
“চামড়া পাচার রোধে সীমান্ত এলাকায় বিজিবির বিশেষ প্রস্তুতি রয়েছে, ” বেনারকে জানান বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহসিন রেজা।
বাগআচড়ার চামড়া ব্যবসায়ী শেখ সহিদুল ইসলাম বলেন, “পেশাদার চামড়া ব্যবসায়ীদের পুঁজি সঙ্কটের সুযোগ নেয় চোরাকারবারীরা। পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে তারা বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে চামড়া সংগ্রহ করে। পরে সুযোগ বুঝে পাচারকারীদের কাছে সেই চামড়া তুলে দেয়।”
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কোরবানির ঈদ হচ্ছে দেশের চামড়া আহরণের সবচেয়ে বড় মৌসুম। সারা বছরে দেশে যে চামড়া সংগৃহীত হয় তার ৮০ থেকে ৮২ ভাগ পাওয়া যায় এই ঈদের সময়।
ব্যবসায়ীদের তথ্য মতে, গত বছর কোরবানি ঈদের পরে ৭০ থেকে ৭৫ লাখ চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন তাঁরা। এবার ওই সংখ্যা বাড়বে বলে তাদের ধারনা।