বিষাদের ছায়ায় মিলিয়ে গেল ক্রিকেটের সব উত্তেজনা
2015.03.19

মায়ের মোবাইল ফোনটি হাতে নিয়ে ঢাকায় কর্মব্যস্ত পিতা আর গ্রামে অবস্থান করা বয়স্ক পিতামহকে একটু পরপর ফোন করছিল সাকীফ বায়েজিদ। বাংলাদেশ–ভারত ক্রিকেটযুদ্ধ দেখতে সে স্কুল বা কোচিংয়ে যায়নি ১৯ জানুয়ারি।
১০৯ রানের বড় ব্যবধানে বাংলাদেশ দল হেরে যাওয়ার পর ওই শিশুটি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। ঢাকার একটি সরকারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র সে।তাঁর মতো লাখ লাখ শিশু–কিশোর ও তরুণরা কেঁদেছে।
“খেলায় হারজিত থাকে। কিন্তু এতো বাজেভাবে খেলে এবং অ্যাম্পায়ারের একপেশে সিদ্ধান্তে হারার বিষয়টি মেনে নেওয়া যায় না,” জানায় সাকীফ।
ভারত ও বাংলাদেশের কোটি কোটি চোখ গতকাল ছিল টেলিভিশনের পর্দায়। নিতান্তই যারা টেলিভিশন দেখার সুযোগ পায়নি, তারা কানে হেডফোন লাগিয়ে রেডিওর ধারাভাষ্য শুনেছে।
প্রথমবারের মতো ক্রিকেট বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ দল প্রতিবেশী দেশ ভারত হওয়ায় মনযোগটা ছিল তুলানমূলক বেশি।
গত কয়েকদিন ধরে চড়তে থাকা দুই দেশের ভক্ত ও সমর্থকদের বাকযুদ্ধ ও উত্তেজনার অবসান হয় ভারতের বিজয়ের মাধ্যমে।
বৃহস্পতিবারের খেলা সামনে রেখে ভারতের অলরাউন্ডার সুরেশ রায়না সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ভারতের আসল বিশ্বকাপ শুরু হলো কেবল। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিজয়ের পর দেশটি শিরোপা জয়ের পথে একধাপ এগিয়ে গেল।
ভারতের ব্যাটিং বরাবরই শক্তিশালী। রোহিত শর্মা, শিখর ধাওয়ান, কোহলি, অজিঙ্কা রাহানে, রায়না, ধোনিরা যে কোনো দলকে গুড়িয়ে দিতে পারেন, এটা নতুন বিষয় নয়।
কিন্তু শুধু ব্যাটিং নয়, এবারের আসরে ভারতের বড় চমক তাদের বোলিং। প্রথমবারের মতো টানা ছয় ম্যাচে প্রতিপক্ষকে অলআউট করার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তারা। এর নায়কেরা হলেন মোহাম্মদ সামি, উমেশ যাদব, মোহিত শর্মা ও রবিচন্দ্রন।
কিন্তু চমৎকার বোলিংয়ে ভারতের ব্যাটসম্যানদের গতকাল বেধে রেখেছিলেন বোলাররা। ৪০তম ওভারের আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে রোহিত বেঁচে যায়। এ ছাড়া মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের আউটের সিদ্ধান্ত নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
এ দুটি ঘটনায় বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষাই বদলে যায়। হতবাক ক্রিকেটারদের বোলিং-ফিল্ডিং সবই যায় এলেমেলো হয়ে যাওয়ার জন্য ওই বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দুটিকে দায়ী করা হচ্ছে।
“বাংলাদেশ দল গতকাল হেরে যাওয়ার কারণ আম্পায়ারদের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে খেলোয়াড়দের মনোবল ভেঙ্গে যাওয়া, অন্যদিকে খারাপ খেলা,” জানান বাংলাদেশ ক্রিকেট ফ্যানস ইউনিটি শেখ ইরফান হোসেন। এই ইউনিটির উদ্যোগে গত কয়েকদিন ধরে তরুণরা আনন্দ–উচ্ছ্বাসের মাধ্যমে বাংলাদেশ দলের শুভকামনা করে আসছিল।
বৃহস্পতিবার সকালে দলের জন্য শুভকামনা জানিয়ে আনন্দ মিছিল করলেও বিকেলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) বিক্ষুব্ধ ছাত্র–জনতা আম্পায়ারদের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে।
অবশ্য আইসিসি সভাপতি আহম মুস্তফা কামাল ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করবে বাংলাদেশ।
তবে এটাও সত্য যে, ৩০২ রানের লক্ষ্য পূরণে বড় কোনো জুটি গড়তে পারেনি বাংলাদেশ। কেউই নিজের ইনিংস বড় করতে পারেননি। তাই লক্ষ্যের ধারে-কাছে যেতে পারেনি তারা। ৪৫ ওভারে ১৯৩ রানে অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ। সর্বোচ্চ ৩৫ রান ছিল নাসিরের।
শুরু থেকেই রানের গতি বাড়ানোর দিকে মনোযোগী ছিলেন তামিম ইকবাল; কিন্তু নিজের ইনিংস খুব একটা বড় করতে পারেননি। ২৫ বলে ২৫ রান করে মহেন্দ্র সিং ধোনির গ্লাভসবন্দি হন তিনি।
তামিমের বিদায়ের পরের বলে রান আউট হয়ে যান ইমরুল কায়েস। ৩৩ রানে দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানকে হারানো বাংলাদেশ তাকিয়ে ছিল সৌম্য সরকার-মাহমুদুল্লাহর দিকে। উইকেটে থিতু হয়ে ফিরে গিয়ে দলকে হতাশ করেছেন তারা।
গত কয়েকদিনের আবেগ ও উত্তেজনা এভাবে বিষাদে ছেয়ে যাবে এটা ভাবতেই পারেনি বাংলাদেশের আম–জনতা। সামাজিক গণমাধ্যম ছাড়াও শেষমুহুর্তে এই ক্রিকেট উত্তেজনা স্পর্শ করে সার্চ ইঞ্জিন গুগলকেও।
গুগলের হোম পেইজ সাজানো হয় দুই প্রতিবেশীর ক্রিকেট যুদ্ধের ডুডলে। ক্রিকেট ম্যাচ শুরুর আগে থেকেই গুগলের এই নতুন ডুডল দেখতে পান উপমহাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা।
বাংলাদেশ ও ভারতের পতাকার রঙে এই ডুডলে ব্যাট হাতে দুই দেশের ছয় ব্যাটসম্যানের প্রতীকী ছবি যেন মাশরাফি আর ধোনি বাহিনীর জমজমাট লড়াইয়েরই ইংগিত দিয়েছিল।
সরেজমিন দেখা যায়, বৃহস্পতিবার দিনভর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আলোচনা আর উত্তেজনা ছিল শুধু বাংলাদেশ–ভারত ক্রিকেট লড়াই নিয়ে। ক্যাম্পাস সুনসান থাকলেও মধুর ক্যান্টিন আর আাবসিক হলগুলোর টেলিভিশন কক্ষে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। খেলা শুরুর পরপরই টিএসসি এলাকায় জাতীয় পতাকা নিয়ে ক্রিকেট দলের সমর্থনে মিছিল করেন একদল তরুণ।
চায়ের দোকান থেকে অফিসপাড়া—সর্বত্রই ছিল ক্রিকেট জ্বর।বিজয় মিছিলের প্রস্তুতি নিয়ে থাকা ক্রিকেটপ্রেমিকরা পড়ন্ত বিকেলে চোখের পানি ফেলে হিম হয়ে যাওয়া বুক হালকা করেছেন।
মেলবোর্ণ ক্রিকেট গ্রাউণ্ডে রীতি অনুযায়ী দুই দেশের জাতীয় সংগীত গাওয়ার পর খেলা শুরু হয়েছিল।এ ক্ষেত্রে দুই দলকে এক সুতায় বেঁধেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কারণ তাঁর লেখা দুটি গান প্রতিযোগী উভয়দেশের জাতীয় সংগীত।