ঢাকার উন্নয়নের নতুন কাঠামো পরিকল্পনা, মেয়রদের আপত্তি

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.09.15
BD-dhaka ঢাকার উন্নয়নে কাঠামোগত পরিকল্পনার আলোচনায় অংশ নেন সংশ্লিষ্টরা। ১৫ সেপ্টেম্বর,২০১৫
বেনার নিউজ

আগামী ২০ বছরকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এবং তার আশপাশের এলাকার জন্য এক 'কাঠামোগত পরিকল্পনার' খসড়া প্রণয়ন করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। তবে নতুন এই কাঠামো পরিকল্পনাকে (ডিএসপি) অগ্রহণযোগ্য বলে মত দিয়েছেন চার সিটি করপোরেশনের মেয়র ও বিশেষজ্ঞরা।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, নির্ধারিত এলাকার মেয়র, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, পেশাজীবী ও সংশ্লিষ্টদের অন্তর্ভুক্ত না করেই খসড়া এ পরিকল্পনা করা হয়েছে। ফলে তা আদৌ বাস্তবমুখী হয়নি। ঢাকার সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে রাজউকের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের যে সমন্বয় প্রয়োজন, তার প্রতিফলন এখানে অনুপস্থিত।

ঢাকার খসড়া কাঠামো পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করতে রাজধানীতে গত রবি ও সোমবার দুই দিনব্যাপী এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। তাড়াহুড়া না করে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়ণের পরামর্শ দেন আলোচকরা।

সেমিনারে অংশ নেওয়া মেয়র ও বিশেষজ্ঞ পেশাজীবীরা বলেন, এ খসড়া পরিকল্পনাকে নতুন পরিকল্পনা হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। এটিকে বড়জোর পুরোনো পরিকল্পনার একটি পর্যালোচনা বলা যেতে পারে, যা প্রতি পাঁচ বছর অন্তর করার বা হওয়ার কথা।


২০১৬-২০৩৫ সাল পর্যন্ত মেয়াদী পরিকল্পনা

ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকার জন্য ২০ বছর মেয়াদী নুতন এই পরিকল্পনার মেয়াদ ২০১৬ সাল থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত। সর্বপ্রথম ১৯৬০ সালে ঢাকার উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়। সর্বশেষ ঢাকা মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা (ডিএমডিপি) নেওয়া হয় ১৯৯৫ সালে।

এবছরই যার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় নতুন ‘নগর উন্নয়ন প্রকল্প’র আওতায় খসড়া পরিকল্পনা করা হয়েছে। রাজউকের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোরিয়ার সামান করপোরেশন ও হান আ আরবান রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট লিমিটেড ও শেলটেক (প্রা.) লিমিটেড যৌথভাবে নতুন এ কাঠামো পরিকল্পনাটি প্রণয়ন করেছে।


কী আছে পরিকল্পনায়

পরিকল্পনাটির খসড়ায় বলা হয়েছে, ২০১১ সালে যে ঢাকায়  দেড় কোটি জনসংখ্যা ছিল, ২০৩৫ সালে তা দাঁড়াবে ২ কোটি ৬০ লাখে। বিরাট এই জনসংখ্যা মাথায় রেখেই সেবা সংস্থাগুলোর প্রসার ও বিন্যাসের কথা চিন্তা করা হয়েছে। যাতে পুরো ঢাকা মহানগরকে ছয়টি অঞ্চলে ভাগ করে বিভিন্ন স্তরের নগর কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা বলা হয়।

এর মধ্যে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রকে ঘিরে গড়ে উঠবে আরও পাঁচটি অঞ্চল। এগুলো হলো গাজীপুর সদর উপজেলা নিয়ে হবে উত্তরাঞ্চল, রূপগঞ্জ ও কালীগঞ্জ নিয়ে পূর্বাঞ্চল, নারায়ণগঞ্জ সদর, বন্দর ও সোনারগাঁ নিয়ে দক্ষিণাঞ্চল, কেরানীগঞ্জ নিয়ে হবে দক্ষিণ-পশ্চিম এবং সাভার এলাকা নিয়ে হবে পশ্চিমাঞ্চল। আর এর বাইরে থাকবে ১৮টি উপাঞ্চলিক এবং ছয়টি বিশেষায়িত এলাকা।

পরিকল্পনা কাঠামোতে চারটি সিটি করপোরেশন (ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর, পাঁচটি পৌরসভা এবং ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার ৭০টি ইউনিয়ন পরিষদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

খসড়া পরিকল্পনায় প্রত্যেক অঞ্চলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ নগর এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। যে অঞ্চলে নাগরিক ও কর্মসংস্থানের সুবিধা বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। ঢাকা শহরে দ্রুতগামী পরিবহনসুবিধা, চারদিকে বৃত্তাকার সড়ক ছাড়াও মূল শহরের সঙ্গে অঞ্চলগুলোর সংযোগ রাখার কথাও উল্লেখ আছে।

ভূমি স্বল্পতাকে বিবেচনায় নিয়ে এসব পরিকল্পনা করা হবে। শহরের চারপাশে থাকবে বিশেষায়িত জোন, ট্রানজিট স্টেশনকে কেন্দ্র করে কর্মক্ষেত্রের চারপাশে মানুষের বসতির সুযোগ থাকবে। প্লটের পরিবর্তে গুরুত্ব পাবে ব্লক হাউজিং। নদী, খাল, জলাশয়, সংরক্ষণ ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা হবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিক রাখা হবে।

এ পরিকল্পনায় পুরো ভূমি ব্যবস্থাপনাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এলাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও সাভার এলাকা। নগর এলাকার বাইরের ভূমিগুলো মূলতঃ কৃষি থেকে শহুরে আবাসনে রূপান্তরিত করা হবে।


সংশ্লিষ্টদের মতামত

এ পরিকল্পনার উপর মতামত দিতে গিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক বলেন, “আগের পরিকল্পনায় কী দুর্বলতা ছিল এবং নতুন করে কতটুকু পরিবর্তন আনা হয়েছে তা এখানে উল্লেখ করা হয়নি। ফলে শুধু এলাকা বৃদ্ধি ও বাড়তি জনসংখ্যার হিসাব ছাড়া এ খসড়া পরিকল্পনাটি বিদ্যমান পরিকল্পনার চর্বিত চর্বণ হয়েছে মাত্র”।

ঢাকার আরেক মেয়র (দক্ষিণ সিটি করপোরেশন) সাঈদ খোকন অভিযোগ করেন, “ক্ষমতা ও দায়িত্বের অতিরিক্ত কার্যক্রম পরিচালনা করায় নগর ব্যবস্থাপনায় চরম ব্যর্থতা ফুটে উঠছে রাজউকের। সমন্বিতভাবে আমরা যদি ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করতে পারি, তাহলে ঢাকাকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। নইলে এর খেসারত দিতে হবে যুগ যুগ ধরে।”

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, “তাড়াহুড়ো করে টেকসই উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। তাছাড়া শুধু পরিকল্পনা করলেই চলবে না। পরিকল্পনাগুলোর সঠিক বাস্তবায়নও করতে হবে।”

আর গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান বলেন, “ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তবে অল্প সময়ের মধ্যে এই প্ল্যানের সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখা সম্ভব হয়নি। এতে প্রচুর ত্রুটিবিচ্যুতি রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হলো। ১৯৯৫ সালে অসংখ্য ভুলসহ ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়। যার বিরুদ্ধে গাজীপুরের মানুষ তখন রাস্তায় নেমেছিল। তাই সকল পক্ষের মতামত ছাড়া কোন পরিকল্পনা করা ঠিক হবে না”।

পরিকল্পনাটির ত্রুটি সম্পর্কে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক আখতার মাহমুদ ক্ষোভের সঙ্গে বেনারকে বলেন, “এ পরিকল্পনাটি খানিকটা অন্ধের হাতি দেখার মতোই বলা যায়। ঢাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিকল্পনা, অথচ এর প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের জনসম্পৃক্ততা নেই। পেশাজীবীদের এখানে যেভাবে অবহেলা করা হয়েছে, তাতে এটি কোনো পরিকল্পনাই হতে পারে না।”

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সারওয়ার জাহান বেনারকে বলেন, “আমাদের একটি শহর হয়ে আছে। এখান থেকে লোকজন উচ্ছেদ করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই পরিকল্পনাটি করার জন্য সব দিক মাথায় রাখতে হবে। রাজউক আকাশ কুসুম কল্পনা করে মানুষের ঘর-বাড়িকে খালি জায়গা বললেই তা মেনে নেবে না জনগণ”।

নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ২০ বছরের জন্য এমন কোনো পরিকল্পনা করা যাবে না, যাতে দুর্যোগ নেমে আসবে। ১ হাজার ৬৪২ কিলোমিটার পরিকল্পনার মধ্যে প্রতিটি বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে নগর সরকার গঠনের বিষয়টিও এখন ভাবতে হবে।
স্থপতি ইকবাল হাবিব বেনারকে বলেন, সবার অংশগ্রহণ ছাড়া ভুলেও খসড়া ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান পাস করানোর চিন্তা করা রাজউকের উচিত হবে না। ভারসাম্যপূর্ণ সমন্বয় নিশ্চিত না করলে চরম মূল্য দিতে হবে।

এ বিষয়ে রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা) আব্দুর রহমান বলেন, সবার জন্য কল্যাণ হবে এমন চিন্তা করেই ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান করা হবে। দু’দিনব্যাপী সেমিনার থেকে আসা প্রস্তাবনাগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে রাজউক। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আবারও আলোচনা করা হবে।

এ বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, “ঢাকার জন্য বাস্তবমুখী ও গ্রহণযোগ্য কাঠামো পরিকল্পনা করতে হবে। ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নও করতে হবে মেয়রদের দিকনির্দেশনা নিয়ে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।