ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস না করার আহ্বান সিপিজে’র

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.08.25
20160809-Editor-Folo1000.jpg অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা মেইলের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকসহ তিনজনকে আদালতে হাজির করা হয়। আগস্ট ০৯,২০১৬।
স্টার মেইল

মন্ত্রিসভায় নীতিগতভাবে অনুমোদিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৬ পাস না করতে সংসদ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সাংবাদিকদের সুরক্ষায় কাজ করা নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট’—সিপিজে।

মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে কাজ করা ওই কমিটির আশঙ্কা হচ্ছে, প্রস্তাবিত এই আইনটি সরকার তার সমালোচনার পথ বন্ধের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে পারে।

গত ২২ আগস্ট মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া ওই আইনে যাবজ্জীবন জেল, কোটি টাকা জরিমানাসহ বিভিন্ন অপরাধের জন্য বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তি নির্ধারণ করার প্রস্তাব রয়েছে। যদিও সরকার বলছে, এই আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সাইবার অপরাধ বন্ধ করা।

গত বুধবার সিপিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়, সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সন্ত্রাসবাদী প্রচার দমন কিংবা স্থিতিশীলতা রক্ষার উদ্দেশ্যের কথা বলা হলেও আইনটি কর্তৃপক্ষের সমালোচনা কিংবা যা তাদের জন্য বিব্রতকর, তা বন্ধের সুযোগ তৈরি করবে।

“যদি আইনটি পাস হয়, তাহলে তা বাংলাদেশে গণমাধ্যমে স্বাধীনতার ওপর প্রভাব ফেলবে,” সিপিজের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি শণ ক্রিস পিনকে উদ্ধৃত করে বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়।

বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের মৃত্যুর গুজব নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশের পর অনলাইন সংবাদপত্র বাংলা মেইলের তিন সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। ওই তিন সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের পর গত ৯ আগস্ট জেলে পাঠানো হয়।

আইনজ্ঞদের অনেকেই প্রস্তাবিত আইনটির বিরোধীতা করে বলছেন, জাতীয় সংসদে এই আইন পাস হলে তা বাক স্বাধীনতার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাঁদের মত হচ্ছে, এ ধরণের আইনে বিশ্বজুড়ে বাক স্বাধীনতার বিষয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করবে। তাঁরা এও বলছেন যে, বাংলাদেশের সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।

“ভাবমূর্তি কতটা ক্ষুণ্ন হয়েছে, ইজ্জতে কতটা আঘাত লেগেছে, মানের কয় সের হানি ঘটেছে ইত্যাদি পরিমাপ করা যায় না। এসব অপরাধের জন্য তাই কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান থাকা উচিত নয়,” বেনারকে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক।

এদিকে সিপিজের বিবৃতিতে বলা হয়, “প্রস্তাবিত আইনে যে ভাষা ব্যাবহার করা হয়েছে, তাতে নির্দোষ সমালোচনাও সাইবার ক্রাইম হিসেবে ধরে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে। আমরা পার্লামেন্টের কাছে জোরালো আহ্বান জানাব, সাংসদেরা যেন এই আইনটি পাস না করেন।”

বিবৃতিতে মুক্ত সাংবাদিকতা এবং মত প্রকাশের সুযোগের অন্তরায় হয়, এমন কোনো আইন ভবিষ্যতে যেন না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদালত কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত মীমাংসিত কোনো বিষয় এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করলে বা এ ধরনের অপপ্রচারে মদদ দিলে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রস্তাব করা হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এর পাশাপাশি এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় শাস্তির প্রস্তাব করা হয়েছে।

দীর্ঘ প্রস্তুতির পর আইনের যে খসড়াটি তৈরি হয়েছে, তা রাষ্ট্রের অন্য কয়েকটি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করার অনুশাসন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। স্বরাষ্ট্র, তথ্য, মুক্তিযুদ্ধ, ডাক ও টেলিযোগাযোগসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে আইনটি চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

“ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি অন্য আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না এবং অন্য আইনের সঙ্গে এটা মিলে যায় কি না, সেটি দেখার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হবে,” বেনারকে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি আরও বলেন, আইনটি নিয়ে যাতে বিভ্রান্তি না হয় এবং স্বচ্ছতা থাকে, সেটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে।

মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান, আইনটি প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়ার কারণ হচ্ছে, অন্যান্য আইনের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য বিধান করা। এ ছাড়া বিভিন্ন অপরাধের জন্য শাস্তির যে মাত্রা প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা।

তবে খসড়া আইন জুড়ে বিভিন্ন অপরাধের জন্য বিভিন্নরকম শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো বা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাইবার অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছর, সর্বনিম্ন দুই বছর; এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

প্রস্তাবিত আইনে অসৎ উদ্দেশ্যে অনুমতি ছাড়া ছবি তুললে বা প্রকাশ করলে দুই বছর কারাদণ্ড, দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। এ ছাড়া গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

নিজের পরিচয় গোপন করে কেউ ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে।

খসড়া আইনে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার প্রধান থাকবেন একজন মহাপরিচালক, যিনি জরুরি পরিস্থিতিতে যেকোনো সম্প্রচারমাধ্যম বন্ধ করতে পারবেন।

কম্পিউটার, মুঠোফোন ও ডিজিটাল মাধ্যমে অপরাধ করলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর, সর্বনিম্ন এক বছর কারাদণ্ড; তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। এ ছাড়া কম্পিউটার বা মুঠোফোনে প্রতারণা ও হুমকি, প্রতারণা বা ঠকানোর উদ্দেশ্যে অন্যের তথ্য ব্যক্তিগত বলে দেখানো, পর্নোগ্রাফি, মানহানি, শত্রুতা সৃষ্টিসহ বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধের জন্য আলাদা শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে নতুন আইনে।

২০০৬ সালে বিএনপির সরকারের সময়ে প্রণীত আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মিথ্যা ও অশ্লীল কিছু প্রকাশ করলে এবং তা দেখে, শুনে কেউ নীতিভ্রস্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হলে, কারও মানহানি ঘটলে, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হলে বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা উস্কানি দেওয়া হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি পাস হলে পুরানো আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বাদ পড়বে। এই ধারাটির বদলে নতুন আইনের ১৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইটে বা ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মানহানি ঘটালে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে। ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মিথ্যা বা অশ্লীল কিছু সম্প্রচার করলে এবং তা মানুষের মনকে বিকৃত বা দূষিত করলে, মর্যাদাহানি ঘটালে বা সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তবে আইসিটি আইনে ইতিমধ্যে দায়ের হওয়া মামলাগুলো ওই আইন অনুযায়ী চলবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।