এবার বাংলাদেশি কূটনীতিককে ফেরত পাঠালো পাকিস্তান

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.01.06
BD-diplomat বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে নাক গলানোর প্রতিবাদে ঢাকায় পাকিস্তানী দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ।
বেনার নিউজ

জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ঢাকা থেকে পাকিস্তানি কূটনীতিক ফারিনা আরশাদকে প্রত্যাহারের জের ধরে এবার ইসলামাবাদ থেকে বাংলাদেশের কূটনীতিককে ফিরিয়ে নিতে বলেছে পাকিস্তান।  সে দেশের বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাউন্সিলর (রাজনৈতিক) মৌসুমী রহমানকে বৃহস্পতিবার বিকেলের মধ্যে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাহার করতে বলেছে দেশটি।

যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের অযাচিত হস্তক্ষেপে দেশটির সঙ্গে অব্যাহত টানাপোড়েনের মধ্যেই এই কূটনীতিক নিয়ে জটিলতার শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার বাংলাদেশের হাইকমিশনার সোহরাব হোসেনকে তলব করে এ অনুরোধ জানায় পাকিস্তান সরকার। তবে বাংলদেশের সিনিয়র এই কূটনীতিকের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলতে পারেনি দেশটি।

কোন কারণ ছাড়াই এভাবে কূটনীতিক বহিস্কারের এ ঘটনা অস্বাভাবিক এবং কূটনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। দেশটির এ আচরণ ঢাকা-ইসলামাবাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে বলে মনে করেন তারা। বারবার পাকিস্তানের এ ধরনের আচরণে বিরক্ত হয়ে এখনই দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রেখেছে বাংলাদেশ।  

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়,  বাংলাদেশ জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার সুস্পষ্ট অভিযোগের কথা পাকিস্তান সরকারকে জানিয়ে ফারিনা আরশাদকে প্রত্যাহারের অনুরোধ জানালেও পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি কূটনীতিক মৌসুমী রহমানের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলতে পারেনি। পাকিস্তানি কূটনীতিকের জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিষয়টি ভিন্ন রূপ দিতে ও কূটনৈতিক টানাপড়েনকে আরো তীব্র করতে ইসলামাবাদ এ উদ্যোগ নিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বেনারকে জানান,  পাকিস্তানে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সোহরাব হোসেন মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পাকিস্তানের ওই অবস্থানের কথা জানান। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মৌসুমী রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনবে না। তাঁকে এরই মধ্যে পর্তুগালে বদলি করা হয়েছে। ৪৮ ঘণ্টা শেষ হওয়ার আগেই তিনি পর্তুগালের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ছাড়বেন।

জানা যায়, যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে টানাপড়েনের সময় বাংলাদেশের হাইকমিশনার সোহরাব হোসেন ছুটিতে ঢাকায় ছিলেন। সে সময় ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মৌসুমী রহমান। তলবের জবাবে ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার হিসেবে তিনি দুই দফায় পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।

এদিকে বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাইকমিশনার সোহরাব হোসেনও শিগগিরই ইসলামাবাদ থেকে ঢাকায় ফিরছেন। আগামী জুলাইয়ে তাঁর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এর আগেই সরকার তাঁকে ফিরিয়ে আনছে সরকার।

সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধাপরাধের দায়ে একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর বাংলাদেশি দোসরদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে পাকিস্তান বিচলিত ও বিরক্ত হয়েছে। সর্বশেষ গত ২২ নভেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী বদর প্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকরের পর 'উদ্বেগ' প্রকাশ করে বিবৃতি দেয় পাকিস্তান।

আভ্যন্তরীন বিষয়ে পাকিস্তানের এই অযাচিত হস্তক্ষেপ ভালো ভাবে নেয়নি বাংলাদেশ। ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানী দূতকে ডেকে এর প্রতিবাদ জানানো হয়। দেশটির হাইকমিশন ঘেরাও কর্মসূচিও পালন করে কয়েকটি সংগঠন।

এরই সূত্র ধরে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে (১৪ ডিসেম্বর) পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। এবার পাকিস্তানি বাহিনীর আরেক দোসর জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের চূড়ান্ত রায়ের আগের দিন বাংলাদেশি কূটনীতিককে ফিরিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানাল পাকিস্তান।


‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টি পর্যবেক্ষণে’

এভাবে বিনা কারণে কূটনীতিক ফেরত পাঠানোর বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, মৌসুমী রহমানকে কেন প্রত্যাহার করতে হবে এ বিষয়ে পাকিস্তান কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। বিষয়টি দুই দেশের সম্পর্কের জন্য সহায়ক নয়।

শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘আমরা কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়বস্তু হতে চাই না। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের স্বার্থে যেটুকু ধৈর্য ধারণ করা দরকার, আমরা তা করব। আমরা ধৈর্য সহকারে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করব’।

পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার মত  পরিকল্পনা এ মুহূর্তে নেই জানিয়ে তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বিষয়ে অভিন্ন কিছু স্বার্থ আছে।


কথা উঠছে সংসদে আলোচনার

এদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা উচিত কি না, তা নিয়ে সংসদে আলোচনার কথা উঠেছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘সরকার তো সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। কাজেই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে তো সংসদে আলোচনা হতেই পারে। তবে আমরা কী করব সেটা সময়ই বলে দেবে’।
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কেউ যদি অগ্রহণযোগ্য অবস্থান নিয়ে থাকেন, কোনো ব্যক্তি বা স্বার্থান্বেষী মহলের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য কেউ যদি ইতিহাসকে ৪৪ বছর পরে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের অপচেষ্টা করেন,  তা আমরা কোনোভাবেই মেনে নেব না। সে ক্ষেত্রে সংসদে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হতে পারে।’

সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোনো সম্ভাবনাই তো উড়িয়ে দিচ্ছি না।’


‘এটা অপমান’

এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে নৌপরিবহনমন্ত্রী ও আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচারের আহ্বায়ক শাজাহান খান বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য অপমান। কূটনীতিক মৌসুমি রহমানের কোনো দোষ নেই।’

শাজাহান খান বলেন, ‘যতই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হচ্ছে পাকিস্তানের গা জ্বালা বাড়ছে। এ জন্য তারা একেকটা ফাঁসির পর একেক ধরনের মন্তব্য করছে। এবার পাকিস্তানের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে একজন কর্মকর্তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি, এটা আমাদের জন্য অপমান। তাঁর কোনো দোষ নেই’।
তিনি আরো বলেন, পাকিস্তানের দূতাবাসের একজন কর্মকর্তাকে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জঙ্গিবাদে মদদ দেওয়ার জন্য তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। সেই কারণে আমাদের দূতাবাসের কর্মকর্তার প্রতি এ ধরনের অপমানজনক ও ন্যাক্কারজনক আচরণ করেছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।


‘সম্পর্ক অবনতির পরিবেশ নিজেই তৈরি করছে পাকিস্তান’

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, দুদেশর সম্পর্ককে নিম্নগামী করতে পাকিস্তানই একের পর এক বিতর্কিত কাজ করে চলেছে। যা কূটণৈতিক সংস্কৃতিতে পড়েনা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “এটা স্পষ্ট যে, তাদের কূটনীতিককে প্রত্যাহারের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশের কূটনীতিককে ফেরত পাঠিয়েছে পাকিস্তান। তারা বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয় থেকে শুরু করে নানা ইস্যুতে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও ধৃষ্ঠতাপূর্ণ আচরণ করছে। যা দুদেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। কূটনৈতিক সংস্কৃতিকে পাশ কাটিয়ে পাকিস্তান যে আচরণ করছে, তা বৈরি সম্পর্কের দেশগুলোর মধ্যেও দেখা যায় না”।

পাকিস্তানের আচরণ ‘উস্কানিমূলক’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “দুদেশের সম্পর্ক ইতিমধ্যে ঝুঁকির মধ্যে আছে। এ ধরনের আচরণ (বিনা কারণে কূটনীতিক ফেরত দেওয়া) আরো ঝুঁকিপূর্ন ও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে কেন্দ্র করে কিছুদিন ধরেই দেশে পাকিস্তানের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি উঠেছে। বিষয়টি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও হয়ত চিন্তাভাবনা হচ্ছে”।

তবে তিনি বলেন,  “কিন্তু সম্পর্কটাকে আরো ক্ষতি করার জন্য পাকিস্তান নিজেই পরিবেশ তৈরি করছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা বাংলাদেশে যে হত্যা চালিয়েছিল, তার বিপরীতে পাকিস্তানের যেখানে ক্ষমা প্রার্থনা করার কথা,  উপলব্ধি করার কথা সেটা না করে তারা বিষয়গুলোকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ”


১৯৫ পাকিস্তানির বিচারের দাবি জোরদার হচ্ছে ঢাকায়

মুক্তিযু্দ্ধের ত্রিদেশীয় চুক্তি অনুযায়ী গণহত্যায় নেতৃত্ব দেওয়া যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত পাক বাহিনীর ১৯৫ সেনা সদস্যের বিচার করার শর্তে ফেরত দেওয়া হলেও স্বাধীনতার পর ৪৪ বছরেও তাদের বিচারের ব্যবস্থা করেনি পাকিস্তান। এদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে ওই পাকিস্তানি সেনাদের বিচারের দাবি জোরালো হচ্ছে।

বুধবারও একাত্তরের সকল যুদ্ধাপরাধী এবং ফেরত পাঠানো ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত  ‘লড়াই’ অব্যাহত রাখার শপথ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ।

শপথে বলা হয়, ‘আমরা শপথ করছি, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাজাকার, আল বদর, জামায়াতে ইসলামীসহ যারা অপরাধ করেছিল সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এবং ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনা, যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, দুই লাখ মা-বোনকে ধর্ষণ করেছে, আমাদের সম্পদ লুট করেছে, অগ্নিসংযোগ করেছে-সেই পাকিস্তানি সৈন্যদের যতদিন বিচার করতে না পারব;  ততদিন পর্যন্ত আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে।’

বৃহস্পতিবার থেকে তাদের বিচারের দাবিতে ঢাকাসহ সারা দেশে গণসংযোগ শুরু করবে  আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার নামে নবগঠিত এই সংগঠন ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।