কূটনীতিকরা আরও নিরাপত্তা চান
2015.10.06

স্বচ্ছতার সঙ্গে দুই বিদেশি নাগরিক তাবেলা সিজার ও কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করার আশ্বাস দিয়েছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে কূটনীতিকদের ডেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী এ আশ্বাস দেন।
সার্বিক নিরাপত্তার আয়োজন জেনে নিয়ে সরকারকে সারা দেশে বিদেশিদের নিরাপত্তায় বাড়তি ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন বিদেশি কূটনীতিকেরা ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় কূটনীতিকদের ব্রিফ করা হয়। সরকারের নেওয়া নিরাপত্তার আয়োজন সম্পর্কে ঢাকায় অবস্থানরত ৪৫টি দেশের রাষ্ট্রদূত ও মিশন প্রধানদের সামনে সরকারের বক্তব্য তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
“বিদেশিদের জন্য সরকার নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করায় আমরা আগের চেয়ে বেশি নিরাপদ বোধ করছি। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে,” ব্রিফিং শেষে সাংবাদিকদের জানান কূটনৈতিক কোরের ডিন ও যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন।
ইইউ রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদু বলেন, “নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থাকায় অনেক ব্যবসায়ী বাংলাদেশে তাদের সফর স্থগিত করছেন। তাই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ব্যবসার পাশাপাশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো দরকার”।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেন, “ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজার ও জাপানের নাগরিক কুনিও হোশির হত্যার দায় স্বীকার করে আইএস বিবৃতি দিয়েছে। আইএসের এই দাবির সত্যতা বিভিন্নভাবে যাচাই করা হচ্ছে”।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ের আগে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রায় সোয়া দুই লাখ বিদেশি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের অবস্থান ও কর্মস্থল চিহ্নিত করা হয়েছে।
“তাদের যাতায়াতের পথ, বিনোদনের স্থান ও সামাজিক যোগাযোগের অবস্থানে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি,” জানান আসাদুজ্জামান।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ায় ইতালীয় নাগরিক সিজার এবং এর ছয় দিনের মাথায় ৩ অক্টোবর রংপুরের এক গ্রামে একই কায়দায় খুন হন জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি।
দুটি ঘটনার পর আইএস হত্যার দায় স্বীকার করেছে মর্মে খবর দেয় জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ’। এতে হঠাৎ করে বাংলাদেশে জঙ্গি উত্থানের সম্ভাবনা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়।
যদিও সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে বলে আসছে, দেশে আইএস এর অস্তিত্ব নেই। আইএস এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত—এমন তথ্য সরকারের কাছে নেই।
“বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর কোনো সাংগঠনিক অস্তিত্ব নেই,” পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার পুলিশ সদর দপ্তরে ত্রৈমাসিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) অপরাধ পর্যালোচনা সভায় এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান আইএস নিয়ে এমন বক্তব্য দেওয়ার পর পুলিশ প্রধানও গতকাল তা পুনরাবৃত্তি করেন।
শহীদুল ইসলাম বলেন, “ব্যক্তিগতভাবে কেউ আইএস-এর আদর্শে বিশ্বাসী হতেও পারে। তবে আমরা এ দেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র হতে দেব না।”
ব্রিফিংয়ে বিভিন্ন প্রসঙ্গ
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গতকালের ব্রিফিংয়ে জাপানের রাষ্ট্রদূত মাসাতো ওয়াতানাবে রংপুরে কুনিও হোশি হত্যার পর সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের জন্য বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তবে তিনি বলেন, দুই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের নিরাপত্তা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
“এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নিরাপত্তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে জাপান এক সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী,” জানান জাপানের রাষ্ট্রদূত।
গতকালের ব্রিফিংয়ে মাহমুদ আলী বলেন, “সম্ভাব্য হুমকির ব্যাপারে বিদেশিরা যে তথ্য পেয়েছিল সেটি তারা সরকারকে জানিয়েছিল। কিন্তু সন্ত্রাসীরা যখন অপকর্ম ও অপরাধ ঘটায়, তখন তো তারা এক জায়গায় থাকে না। জায়গা বদল করে।”
বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের ভ্রমণ বিষয়ক যে সতর্কবার্তা দিচ্ছে এটি প্রত্যাহারের ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, “তারা তো এটি জারি করেছেন বেশ কয়েক দিন হলো, আগামী কয়েক দিন পর আশা করি সেটি প্রত্যাহার হবে।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্রিফিংয়ের পর রবার্ট গিবসন বলেন, “বাংলাদেশ সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে আমরা কৃতজ্ঞ।” তিনি বলেন, ‘সারা দেশে বিদেশিদের’ নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়েই তারা কথা বলেছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “সবকিছুতে তারা (কূটনীতিকেরা) সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে বলেছেন। আমরা তাদের নিশ্চিত থাকতে বলেছি, তাদের আশ্বস্ত থাকতে বলেছি।”
শুধু কূটনৈতিক এলাকা নয়, প্রত্যন্ত এলাকাতেও বিদেশিরা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করা বিদেশিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
ব্রিফিংয়ে অন্যান্যের মধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট, রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার নিকোলায়েভ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদু উপস্থিত ছিলেন।
সরকারের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, স্বরাষ্ট্রসচিব মোজাম্মেল হক খান, পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক, পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল ইসলাম, র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ও ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আসাদুজ্জামান প্রমুখ।
ঢাকা চেম্বারের উদ্বেগ
ঢাকায় ইতালীয় ও জাপানি নাগরিক হত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) । ব্যবসায়ীদের এই সংগঠনটি মনে করে, “এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় দেশের পণ্য রপ্তানিসহ অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এতে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।”
ঢাকা চেম্বার থেকে মঙ্গলবার বিকেলে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব উদ্বেগের কথা জানানো হয়। সংগঠনটির আশঙ্কা, বিদেশিদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য খাতের অর্ডারগুলো পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চলে যেতে পারে।
ডিসিসিআই বিদেশি নাগরিকদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা যেন বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণ এবং রপ্তানি বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, সে জন্য বিদেশি ক্রেতা ও নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।
দুই আসামি রিমান্ডে
জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে হত্যা মামলায় দুজনের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত । তাঁদের মধ্যে একজন হলেন কুনিওর ব্যবসায়িক অংশীদার হুমায়ূন কবির ও অন্যজন হলেন মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ-উন-নবী ওরফে বিপ্লব। গতকাল মঙ্গলবার রংপুর মহানগর আদালতের বিচারক আবু তালেব এ রিমান্ড আদেশ দেন।
“এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে এ দুজনকে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হলে আদালত তা মঞ্জুর করেন,” বেনারকে জানান কাউনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল করিম।
গত শনিবার রংপুর শহরের উপকণ্ঠে কাউনিয়ার কাচু আলুটারি গ্রামে মোটরসাইকেল আরোহী তিন ব্যক্তি কুনিও হোশিকে গুলি করে হত্যা করে। ওই দিনই কুনিওর বাড়িওয়ালা এ কে এম গোলাম জাকারিয়া, রিকশাচালক মুন্নাফ আলী, কুনিওর অংশীদার হুমায়ুন কবির ও প্রত্যক্ষদর্শী মুরাদ হোসেনকে (যার বাড়ির সামনে হত্যাকাণ্ড ঘটে) ‘জিজ্ঞাসাবাদের’ জন্য আটক করা হয়।
অন্যদিকে ইতালীয় নাগরিক তাবেলা সিজার হত্যায় কোনও অগ্রগতি নেই। পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।