রিজার্ভ ২৭ বিলিয়নে পৌঁছালো, আত্নতুষ্টির কিছু নেই মনে করেন অর্থনীতিবিদরা
2015.10.30

বাংলাদেশে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ আরো এক নতুন মাইল ফলক স্পর্শ করেছে। এবার প্রথমবারের মত বাংলাদেশ ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় ২৭ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়েছে। মাত্র দুই মাসে আগে আগস্টে যা ২৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কাজী ছাইদুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, “বৃহস্পতিবার দুপুরে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। প্রতি মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয়ের খরচ হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে প্রায় সাত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে।”
কাজী ছাইদুর জানান, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এবং রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকায় গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এছাড়া জ্বালানি তেল এবং খাদ্যপণ্য আমদানি খাতে খরচ কম হওয়ার কারণেও রিজার্ভে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
গভর্নরের সন্তোষ প্রকাশ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করায় সন্তোষ প্রকাশ করে গভর্নর আতিউর রহমান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “অনেক দেশ ঘাটতির সমস্যায় থাকে। কিন্তু আমরা আছি মধুর সমস্যায়, উদ্বৃত্তের সমস্যায়। এটি অত্যন্ত সুখের কথা।
তিনি বলেন, “আমাদের আমদানি বাড়ছে। তারপরও বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাড়ছে। কারণ রপ্তানি ও রেমিটেন্স বাড়ছে। আমার মনে হয়, বৈদেশিক বিনিয়োগও বাড়ছে। যার হয়ত পুরোটা (কী পরিমান বিনিয়োগ আসছে তার প্রকৃত তথ্য) আমরা ধরে (নির্ণয় করা) উঠতে পারছি না।”
এর আগে গত ১৭ আগস্ট রিজার্ভ প্রথমবারের মত ২৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ২০১৩ সালের ৫ মে এই রিজার্ভ ১৫ বিলিয়নের ঘর ছাড়ায়।
অর্থনীতির স্বাভাবিক হিসাবে ধরা হয়, কোনো দেশের তিনমাসের মোট আমদানি ব্যয়ের সমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকলে তা সন্তোষজনক। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে সাত মাসেরও বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এতো বেশি রিজার্ভ দেশের জন্য কিছুটা ইতিবাচক ব্রান্ডিং হলেও দেশের শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য তা মোটেই শুভ ইঙ্গিত নয়।
দেশের ব্যান্ডিং
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “বৈদেশিক মুদ্রার ভালো রিজার্ভ আছে-এটা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক ব্রান্ডিং। বিদেশিরা জানতে পারছে, দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী লেনদেন করার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে। একারণে দেশে এখন বড় ধরনের প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব আসছে”।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামও রিজার্ভের একটি মাত্র ইতিবাচক দিক আছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি বেনারকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম কমছে, ফলে আমাদের আমদানি খরচও কমেছে। সেই উদ্বৃত্ত অর্থ রিজার্ভে জমা হচ্ছে। এটাই ইতিবাচক দিক।
‘উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই’
তবে এই রেকর্ড পরিমান রিজার্ভ নিয়ে খুব বেশি সন্তুষ্ট হওয়ার কিছু নেই বলেই অভিমত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশে কাঁচামাল ও মধ্যবর্তি পণ্যের আমদানি কমেছে। আমাদের দেশের উৎপাদন এসব কাঁচামাল আমদানির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু সেসব আমদানি কমে গেছে বলেই রিজার্ভের পরিমান বেড়েছে। আবার বাজার থেকে বেশিমূল্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশি মুদ্রা কেনাও রিজার্ভ বাড়ার আরেকটি কারণ।
তাঁরমতে, ডলারের মূল্য কমলে এর বিপরীতে টাকার মান বেড়ে যায়। তখন রফতানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদেরকে রক্ষা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাইরে থেকে বেশি টাকা দিয়ে ডলার কেনে। ২০১৩ অর্থ বছরের পর থেকে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাড়ে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মার্কেট তৈরি করেছে। রিজার্ভ বাড়ার বেশিরভাগ অংশেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কেনা এই বিদেশি মুদ্রা। কিন্তু এই মুদ্রা উৎপাদন এবং বিনিয়োগে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সুতরাং এটা নিয়ে বেশি উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “এই রিজার্ভ বসিয়ে না রেখে কীভাবে দেশের উৎপাদন ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যবহার যায়, তা দেখতে হবে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা, অবকাঠামোর সমস্যা দূর করাসহ নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে সরকার।”
ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, “আমরা বারবারই বলছি, এই রিজার্ভে আত্ম-তুষ্টিতে ভোগার কোনো কারণ নেই। কারণ, কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি বা ব্যবসায় বিনিয়োগ হচ্ছে না বলেই রিজার্ভ বাড়ছে। এই অর্থ না জমিয়ে, তা খরচ করে দেশের উৎপাদনশীলতার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। রিজার্ভের পরিমান কমাতে হবে”।
এদিকে ব্যবসা পরিবেশের বিচারে বিশ্ব ব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের সূচকে বাংলাদেশের দুই ধাপ অবনমন ঘটেছে। যা নতুন ব্যবসা শুরু করা, অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি পাওয়া, বিদ্যুত সুবিধা, সম্পত্তির নিবন্ধন, ঋণ পাওয়ার সুযোগ, সংখ্যালঘু বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা, কর পরিশোধ, বৈদেশিক বাণিজ্য, চুক্তি বাস্তবায়ন ও অসচ্ছলতা দূরীকরণ- এই দশটি মাপকাঠিতে তুলনা করে এ সূচক নির্ধারিত হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেশে ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে সরকারকে। তবেই বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি রিজার্ভেরও সঠিক ব্যবহার হবে।