২৪ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে রিজার্ভ, ‘শুভ ইঙ্গিত নয়’ মন্তব্য অর্থনীতিবিদদের
2015.05.01

প্রথমবারের মত বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ চব্বিশ বিলিয়ন ডলারের (দুই হাজার ৪০০ কোটি) ঘর অতিক্রম করেছে। বুধবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ২৪ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর খবর নিশ্চিত করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কাজী ছাইদুর রহমান।
অর্থনীতির স্বাভাবিক হিসাবে ধরে নেওয়া হয় যে, কোন দেশের তিনমাসের মোট আমদানি ব্যয়ের সমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকলে তা সন্তুষজনক। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে সাত মাসেরও বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এতো বেশি রিজার্ভ দেশের জন্য কিছুটা ইতিবাচক ব্রান্ডিং হলেও দেশের শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য তা মোটেই শুভ ইঙ্গিত নয়।
তাঁদের মতে, মূলত আমদানির শ্লথ গতির কারণেই রিজার্ভ বাড়ছে। আমদানি না থাকায় দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে না। আবার রিজার্ভের পরিমাণ বেশি হওয়ায় স্থানীয় মুদ্রাবাজারে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাচ্ছে, যা রপ্তানিকারকদের জন্য সুখবর নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযাযী, গত বছরের ২২ এপ্রিল রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২০ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে ২৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই রিজার্ভ দিয়ে সাত মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
রেকর্ড পরিমান রিজার্ভ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, রিজার্ভ বাড়াটা অর্থনীতির জন্য খুব একটা সুখবর নয়। আমাদের মত দেশে শিল্পের মধ্যবর্তি পণ্য, কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি সবই আমদানি নির্ভর। সেখানে যদি আমদানির পরিমান না বাড়ে, তার অর্থ দেশের উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। কাজেই এখন রিজার্ভ বাড়ার অন্যতম কারণ আমদানির শ্লথ গতি। যা মোটেই সুখকর নয়।
তিনি বলেন, উচ্চ রপ্তানির বা রেমিটেন্সের কারণে রিজার্ভ বাড়লে অর্থনীতির জন্য তা ইতিবাচক হতো। কিন্তু গত আট মাসে রপ্তানির পরিমান ২.৬ বা ২.৭ বিলিয়নের বেশি নয়। আবার রেমিটেন্সও সেই হারে বাড়েনি। সে কারণে রিজার্ভ বাড়ার বড় কারণ হলো, বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে পারছে না। ব্যবসায়ীরা শিল্প কারখানায় বিনিয়োগ করলে এতো বেশি রিজার্ভ হতো না। তাতে রিজার্ভ কমলেও দেশে কর্মসংস্থান হতো, উৎপাদন বাড়তো-যা অর্থনীতিতে ভূমিকরা রাখতো।
তবে রিজার্ভ বাড়ার শুধুই নেতিবাচক দিক দেখেন না বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রধান গবেষক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, বৈদেশিক রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন থাকার ফলে দেশে এবং দেশের বাইরে একটা ইতিবাচক বার্তা যাচ্ছে যে, দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী লেনদেন করার সক্ষমতা আমাদের আছে। একারণে এখন বড় ধরনের প্রকল্পে বিদেশী বিনিয়োগের প্রস্তাব আসছে।
তিনি বলেন, তবে বেশি ডলার জমে যাওয়ার ফলে ডলারের বিপরীতে টাকা দূর্বল হয়ে পড়ছে। যার ফলে প্রতিযোগী অন্যান্য দেশ যেমন ভারত, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান বা ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় আমাদের দেশের রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদও বেশি রিজার্ভের ইতিবাচক দিকটি উল্লেখ করেন শুরুতেই। তিনি বলেন- বৈদেশিক মুদ্রার ভাল রিজার্ভ আছে-এটা দেশের ইতিবাচক ব্রান্ডিং। কিন্তু তাতে আত্ম-তুষ্টিতে ভোগার কোন কারণ নেই। কারণ, অর্থটা কোন কাজে লাগছে না। কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আসছে না, ব্যবসায় বিনিয়োগ হচ্ছে না। বরং এই অর্থ না জমিয়ে, তা খরচ করে দেশের উৎপাদনশীলতার সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত।
তবে এসবের সঙ্গে মোটেই একমত নন বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলতঃ রপ্তানি ও রেমিটেন্সে ভালো প্রবৃদ্ধির ফলে বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতি শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড়িয়েছে বলে দাবি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কাজী ছাইদুরের।
তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে। যার ফলে এ খাতে ব্যয় কমেছে। যা রিজার্ভ বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। তবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের বিল শোধ করলে রিজার্ভের পরিমান কমে আসবে বলেও জানান ছাইদুর।
তিনি জানান, এ সংস্থাটির মাধ্যমে এশিয়ান দেশগুলোর ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা হয়। দুই মাস পরপর পরিশোধ করতে হয় আকুর বিল।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ২৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদের ১০১ কোটি ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর তা ২২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ৩০ মার্চ তা ফের বেড়ে ২৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১ এপ্রিল থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত রেমিটেন্স এসেছে ১০৫ কোটি ডলার। পুরো এপ্রিল মাস শেষে রেমিটেন্সের পরিমাণ ১৩০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-মার্চ পর্যন্ত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স আসে ১ হাজার ১২৫ কোটি ২৪ লাখ ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ২১ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩ শতাংশ। ২০০৯ সালের ১০ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার।
২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে তা ১৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ৩০ জুন রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায় গত বছরের ৭ অগাস্ট। আকুর বিল পরিশোধের পর তা কমে যায়।