বৈশ্বিক সক্ষমতা সূচকে দুই ধাপ অগ্রগতি বাংলাদেশের, বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে
2015.10.02

এক বছরের ব্যবধানে বৈশ্বিক সক্ষমতার সূচকে দুই ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ও অবকাঠামো উন্নয়নের মতো মৌলভিত্তির ক্ষেত্রে এ সামান্য উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে। তবে ব্যবসার বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা ও উৎকর্ষতা অর্জনে পিছিয়ে বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদরা যাকে দুশ্চিন্তার কারণ বলে মনে করছেন।
এ বছর র্যাংকিংয়ে ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৭, যা গতবার ছিল ১০৯।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচক প্রতিবেদন, ২০১৫-১৬তে বিষয়টি উঠে এসেছে। গত বুধবার সারা বিশ্বে একযোগে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ডব্লিউইএফ। ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম, সংলাপ ও যোগাযোগ বিভাগের পরিচালক আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ, জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ।
মৌল ভিত্তির সূচকে অগ্রগতি
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবসা করার মৌল ভিত্তির কিছু সূচকে অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশের। এর মধ্যে অবকাঠামো, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বাজারের আকার উল্লেখযোগ্য। এসব সূচকের প্রতিটিতে বাংলাদেশের অবস্থানের উল্লম্ফন হয়েছে আবার নম্বরও আগের চেয়ে বেড়েছে।
অবকাঠামোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্কোর বেড়ে হয়েছে ৭-এর মধ্যে ৩ দশমিক ৯৩, যা আগে ছিল ৩ দশমিক ৮৪। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় বাংলাদেশের র্যাংকিং ৪৯ এবং স্কোর ৪ দশমিক ৯৮, যা গতবছর ছিল ৭২ এবং ৪ দশমিক ৬৯। আর বাজারের আকারের দিক থেকে বাংলাদেশ ৪০তম স্থানে রয়েছে। অন্য ভিত্তিগুলোর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও প্রাথমিক শিক্ষায় এবার বাংলাদেশের র্যাংকিং যথাক্রমে ১৩২, ১২৩ ও ১০১, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১৩১, ১২৭ ও ১০২।
দক্ষতা সূচকে পিছিয়ে
প্রতিবেদন অনুসারে দক্ষতা বৃদ্ধিতে গতবারের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দক্ষতা বৃদ্ধির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৫তম, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১০৩তম। এক্ষেত্রে এবার সবচেয়ে বেশি অবনতি হয়েছে পণ্যবাজার দক্ষতায়, যা বাংলাদেশকে র্যাংকিংয়ে ৮৪তম থেকে ১০১তে নিয়ে এসেছে। দক্ষতা কমেছে উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, শ্রমবাজার, অর্থবাজারে সূক্ষ্মতা আনয়ন, প্রযুক্তি ও বাজার সম্প্রসারণেও।
অন্যদিকে নতুন উদ্ভাবন ও সূক্ষ্মতা আনয়নেও র্যাংকিংয়ে একধাপ পিছিয়ে ১২২ থেকে ১২৩তম অবস্থানে নেমেছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে দশমিক ৭ শতাংশ স্কোরও কমেছে।
নিট সম্পদের পরিমাণ ১০ কোটি টাকার বেশি, বাংলাদেশের এমন ৫৬ জন উদ্যোক্তার মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ কেমন ছিল- সে বিষয়ে তাদের কাছ থেকে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মে সময়ে এ মতামত নিয়েছে সিপিডি। ব্যবসায়ীরা এদশের দুর্বল অবকাঠামো, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সরকারে অস্থিরতা, ব্যবসায়িক অর্থায়নের জটিলতা আর নীতি সহায়তার বাধাগুলোর কথা জানিয়েছেন জরিপে। দেশের অভ্যন্তরে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় আমদানি-রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।
সরকারের স্থিতিশীলতা নিয়ে সংশয়
জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীরা সরকারের স্থিতিশীলতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় প্রকাশ করেছেন বলে জানান সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, “আগের বছর জরিপে অংশগ্রহনকারীদের ৯ দশমিক ৪ শতাংশ ব্যবসায়ী সরকারের স্থিতিশীলতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিল। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৬ শতাংশে। এছাড়া আর্থিক পরিষেবায় ব্যবসায়ীদের খরচ বেড়েছে বলেও তারা অভিমত দিয়েছে, ব্যাংক ঋণের পেছনে ব্যয় বেড়েছে বলে মত দিয়েছেন ৬৬ শতাংশ।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কমেছে
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে আছে সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার ক্ষেত্রে। বিশ্বের ১৪০টি দেশের মধ্যে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩২ নম্বরে। এছাড়া আগের বছরগুলোতে সংবাদ মাধ্যমে স্বাধীনতা বাড়তে দেখা গেলেও এবার সেটি ভয়াবহভাবে কমেছে। এবার সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছে ৫৪ শতাংশ উত্তরদাতা। গত জরিপে যা ছিল ৫১ শতাংশ। প্রথমবারের মতো সংবাদ মাধ্যম নিয়ে এমন নেতিবাচক মনোভাব উঠে এসেছে।
‘সন্তোষজনক নয়’ মন্তব্য অর্থনীতিবিদের
অর্থনীতিদরা বলছেন সক্ষমতা সূচকে বাংলাদেশের সামান্য এই অগগতি কোনভাবেই সন্তোষজনক নয়।
সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ১৪০টি দেশের মধ্যে ১০৭তম অবস্থান নিয়ে সস্তির ‘ঢেকুর তোলার’ কিছু নেই। খুশি হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি করতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে বাংলাদেশে। এর জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন সুশাসন। যা না আসা পর্যন্ত কোন ভাবেই পরিস্থিতি বদলাবে না। এছাড়া দুর্নীতি বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য অন্যতম একটি বাধা, যার কারণে বিনিয়োগ, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আর জরিপকারী প্রতিষ্ঠান সিপিডি বলছে, এই অগ্রগতিতে তৃপ্তির কিছু নেই। প্রতিযোগী বা সমমানের অন্য দেশগুলো যখন লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে, সেখানে তুলনামূলক ধীরগতিতে এগুচ্ছে বাংলাদেশ। যা দিয়ে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া কঠিন।
সিপিডি’র ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ যখন কয়েক ধাপ এগিয়েছে সেখানে বাংলাদেশের এ গতি কচ্ছপের মতো। বিক্ষিপ্তভাবে মৌলভিত্তি সংক্রান্ত কোনো কোনো সূচকে সামান্য ভালো করলেও দক্ষতা ও উৎকর্ষতার ক্ষেত্রে পিছিয়েছে বাংলাদেশ। অর্থনীতির এই দুর্বলতা দূর না কলে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ গড়া সত্যি কঠিন হয়ে দাঁড়াবে”।
তিনি বেনারকে বলেন, দক্ষতার সূচকগুলোর মধ্যে রয়েছে উচ্চশিক্ষা, আর্থিক বাজারের উৎকর্ষতা, বাজারের আকার, বাজারের দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি। এগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র বাজারের আকার ছাড়া সবগুলোতে বাংলাদেশ পিছিয়েছে। যেমন প্রযুক্তিখাতে বিশ্ব প্রতিযোগিতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগুতে পারেনি বাংলাদেশ। ব্যাংক ঋণ পেতে অসুবিধা, উচ্চমাত্রার সুদহার, সেবার গুণগত মাত্রা প্রভৃতির ক্ষেত্রেও অভিযোগ তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া দেশে একদিকে দক্ষ কর্মীর বড় অভাব, আবার মেধা পাচার অব্যাহত রয়েছে। মৌল ভিত্তির সঙ্গে সঙ্গে এসব দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে যে বড় ধরনের আশা আমাদের, সে তুলনায় অগ্রগতি সামান্যই। তবে অগ্রগতির দিকে আমরা এখন হাঁটছি, আমাদের দৌড়াতে হবে।
কিছু আশার কথা শুনিয়ে তিনি বলেন, “পুঁজিবাজার, কমমূল্যে শ্রম প্রভৃতি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। এদেশে দুর্নীতির অভিযোগ যেমন আছে, তেমন দুর্নীতি দমন কমিশন আছে। তবে সেটাকে কার্যকরী করতে হবে। জনপ্রশাসনের অদক্ষতা নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে, এর বিপরীতে সম্প্রতি পে স্কেল বৃদ্ধি প্রসাশনের দক্ষতা বাড়াতে প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা যায়।”
অন্য দেশের অবস্থান
সক্ষমতা সূচকে টানা সপ্তমবারের মত শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে সুইজারল্যান্ড। এ ছাড়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্র। আর তালিকায় সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশ (১৪০তম) গায়েনা।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে ভারত (৫৫), শ্রীলঙ্কা (৬৮), নেপাল (১০০) ও ভুটান (১০৫)। পাকিস্তানের অবস্থান ১২৬তম। এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিযোগী অন্য দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনাম ১২ ধাপ এগিয়ে ৫৬তম এবং কম্বোডিয়া ৫ ধাপ এগিয়ে ৯০তম স্থানে রয়েছে।