বিশ্বব্যাংক বলছে, অর্থনীতি স্থিতিশীল তবে অনিশ্চয়তার ঝুঁকিও রয়েছে
2015.10.20

সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল হলেও অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার ঝুঁকিও বিদ্যমান, এই বিশ্লেষণ বিশ্বব্যাংকের।
এক দশক ধরেই মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন গড়ে ৬ শতাংশের কাছাকাছি আটকে থাকলেও বাংলাদেশ তা ৭ শতাংশে উন্নীত করতে পারছে না। বিশ্বব্যাংক বলেছে, আগামী অর্থ বছরেও এটা সম্ভব নয়।
গতকাল মঙ্গলবার আগারগাঁওয়ের কার্যালয়ে বসে বিশ্বব্যাংক যখন এই শঙ্কার কথা জানাচ্ছিল, প্রায় একই সময়ে খানিকটা দূরে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অনুমোদন নিয়ে সরকারের নীতি নির্ধারক পর্যায়ের বৈঠক হচ্ছিল। আর সেই পরিকল্পনার লক্ষ্য হচ্ছে ২০২০ সাল নাগাদ ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন।
যদিও প্রবৃদ্ধির এই লক্ষ্যমাত্রা যথেষ্ট উচ্চাভিলাষী বলে মত দিয়ে বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এর সমালোচনা করেন।
অবশ্য বিশ্বব্যাংক বলছে, বেসরকারি বিনিয়োগের ফাঁদ থেকে বের হতে পারলেই কেবল বাংলাদেশ ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল বলে মত দিলেও অনিশ্চয়তা ও শঙ্কার কথা উড়িয়ে দেয়নি সংস্থাটি।
গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলে অনুমোদন দেওয়া হয়, যার লক্ষ্য ২০২০ সালে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত করা এবং আগামী পাঁচ বছরে এক কোটি ২৯ লাখ লোকের কর্মসংস্থান করা।
এনইসি চেয়ারপারসন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলন কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এ পঞ্চবার্ষিক দলিলে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ১৮ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে। বর্তমানে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। পুরো পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে ৩১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা লাগবে।
“বাংলাদেশ যে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে, এটা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সুফল। শুধু রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ দিলেই হবে না, মানুষের সামাজিক উন্নয়নও করতে হবে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০২১, ২০৩০ ও ২০৪০ সালের উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করেছে,” সভা শেষে সাংবাদিকদের জানান পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিল তৈরি করেছে। ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সরকার কি ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়েছে, তার দলিল হলো এ সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এর আগে ছয়টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও দুটি দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ।
বর্তমানে অতি দারিদ্র্য হার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০২০ সালে এসে তা ৮ দশমিক ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। পরিকল্পনা মেয়াদকালে পদ্মাসেতু ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ হবে। এ ছাড়া গভীর সমুদ্র বন্দর, মেট্রোরেল, এলএনজি টার্মিনাল, পায়রা সমুদ্র বন্দরের মতো বড় প্রকল্পে বিনিয়োগকেই প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, আগামী পাঁচ বছরে দেশে নতুন করে ১২ হাজার ৫৮৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এর মধ্যে সরকারি খাত থেকে সাত হাজার ৬৮২ মেগাওয়াট ও বেসরকারি খাতে চার হাজার ৯০২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। ২০২০ সাল নাগাদ মোট উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়াবে ২৩ হাজার মেগাওয়াট।
অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা
দলিলের রাজস্ব আহরণ, বিদেশি বিনিয়োগসহ বেশ কিছু খাতে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে—এর সমালোচনা করে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এসব লক্ষ্য বাস্তবসম্মত নয়।
অর্থমন্ত্রী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলের সমালোচনা করে বলেন, “রাজস্ব ও জিডিপি অনুপাত ১৬ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। নো ওয়ে টু এচিভ। এটা বোগাস, সম্ভব নয়।”
সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের লক্ষ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “২০২০ সালে ৯ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এখন বিদেশি বিনিয়োগ আসে বছরে গড়ে দেড় বিলিয়ন ডলার। ৫ বছরে বিদেশি বিনিয়োগ ৯ বিলিয়ন ডলারে যাবে, এটা ইমপ্র্যাকটিক্যাল, আনরিয়েলস্টিক।”
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, “বিদেশি সহায়তার পরিমাণ জিডিপির ৩ শতাংশ উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। এটা আনরিয়েলস্টিক, কিছুতেই সম্ভব নয়। সর্বোচ্চ দুই শতাংশ হতে পারে।”
“পরিকল্পনার এসব লক্ষ্য অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসেই ঠিক করা হয়েছে। তখন আপত্তি তোলা হয়নি,” বেনারকে জানান পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য শামসুল আলম।
বিদেশি বিনিয়োগ সম্পর্কে তিনি বলেন, “ভিয়েতনাম যদি বছরে ২২ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ পায়, তবে আমরা কেন ৯ বিলিয়ন ডলার আনতে পারব না? আমরা বলেছি, এ জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হবে। চীনের বিনিয়োগ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে, সেটা ধরতে হবে।”
বিশ্বব্যাংকের সংবাদ সম্মেলন
বিশ্বব্যাংক গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্জন ও ঝুঁকিগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
সংস্থাটির পূর্বাভাস হচ্ছে, চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক মনে করছে, প্রাক্কলন করা এই প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হবে ভোগ ও রপ্তানি।
বেসরকারি খাত কেন বিনিয়োগ করছে না—সেই প্রশ্ন ওঠে বিশ্বব্যাংকের সংবাদ সম্মেলনে।
“একজন বিনিয়োগকারী যদি দেশের মধ্যে বা বিদেশে পণ্য বিক্রি করা নিয়ে স্বস্তিতে না থাকেন, তা হলে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেবেন না। সুতরাং মূল কাজ স্বস্তির পরিবেশটা দেওয়া,” সংবাদ সম্মেলনে জানান বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, বিনিয়োগ পরিবেশের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা একটি বড় বিষয়। এর সঙ্গে আরও আছে পরিবহন ও বন্দরের মতো অবকাঠামো-সুবিধা পাওয়া। এর পাশাপাশি সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির কথা বলছে। এটাও দ্রুত হওয়া প্রয়োজন।
প্রবৃদ্ধির এই পূর্বাভাস দিয়ে ড. জাহিদ হোসেন অবশ্য বলেছেন, “সংখ্যা নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো। কারণ, এতে কেবল তাপই ছড়ায়, আলো দেয় না।”
তবে বিশ্বব্যাংক এ সময় জানায়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পূর্বাভাস হচ্ছে প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ, আর আইএমএফ বলছে সাড়ে ৬ শতাংশ।
বিশ্ব অর্থনীতির পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করেন ড. জাহিদ হোসেন। তাঁর ভাষায়, বিশ্ব অর্থনীতি এখন পৌষ মাসের সকালের মতো অবস্থায়। যখন কুয়াশা থাকে, সামনের কিছু তেমন দেখা যায় না। এর একটি প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতিতে থাকবে।
“তবে বাংলাদেশের জন্য বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ ঝুঁকিও আছে। যেমন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সরবরাহব্যবস্থায় বাধা সৃষ্টি,” জানান ড. জাহিদ।