ঈদের আগেই ঢাকা শহর ফাঁকা

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.07.16
BD-eid ঈদের কয়েকদিন আগে থেকে ঢাকা ছেড়ে বাড়ির দিকে ছুটতে গাড়ি ধরছেন অনেকেই। ১৫ জুলাই,২০১৫
বেনার নিউজ

ঈদ এসেছে। পরিবারের সবার সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে ‘বাংলাদেশের প্রাণ’ হিসেবে পরিচিত গ্রামগুলোতে ফিরছেন লাখ লাখ মানুষ। ফলে ফাঁকা হতে চলেছে রাজধানী ঢাকা।

রাজধানীর চারদিকের রেল ষ্টেশন, বাস ও লঞ্চ টার্মিনালে এখন শুধু ঘরমুখো মানুষের ঢল। বিরাট সংখ্যক মানুষ ঢাকা ছাড়ায় যানজট, আর মানুষের আধিক্যের চিরচেনা শহরটি যেন অচেনা হয়ে পড়েছে। সেই যানজট নেই। বাসগুলোতে ঠাসা ঠাসা যাত্রী নেই। বাজারে উপচে পড়া ভীড় নেই।
ঈদ বা বড় কোন পার্বন এলেই ঢাকা শহরের এই ভিন্ন চিত্র চোখে পড়ে।

নগরবিদরা বলছেন, রাজধানীর প্রকৃত চেহারা এমনই হওয়া উচিত। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ন, ক্ষমতা আর নগর সুবিধা কেন্দ্রিভূত করার নেশায় রাজধানী আর নগর কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে সরকারের উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি। ফলে জীবন আর জীবিকার তাগিদে সাধারণ মানুষ শহরমুখী হতে বাধ্য হচ্ছেন।

নগর-পরিকল্পনাবিদ এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব বেনার নিউজকে বলেন, “ঈদের ছুটিতে গ্রামে যাওয়াদের বিরাট একটি অংশ সুযোগ পেলে ‘সত্যিকার অর্থেই’ ঢাকায় ফিরতে চান না। কিন্তু সরকার সে সুযোগ করে দিতে ব্যর্থ হয়েছে”।


গ্রামে উন্নয়ন ছড়িয়ে দিতে হবে

ইকবাল হাবিব বলেন, গ্রামই বাংলাদেশের প্রাণ শক্তি। সেটা প্রমাণ হয় ঈদের মত উৎসব এলে। পেটের তাগিদে ঢাকায় আসা মানুষগুলো নাড়ির টানে গ্রামে ফিরে যায়। তবে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেলে থাকার জন্য তারা নিজ এলাকাকেই বেছে নেবেন। এর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, সম্পদ, রাজনীতি, প্রসাশন, বিচার বিভাগের সঠিক বিন্যাস এবং শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণ করা জরুরি।

তিনি বলেন, “স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতায়নের মাধ্যমে প্রসাশন এবং স্থানীয় কর্মসংস্থানকে উজ্জীবিত করতে হবে। সারা বাংলাদেশের উন্নয়নকে একটি সুষমবণ্টিত উন্নয়ন হিসেবে পুনর্গঠন করতে হবে”।

“একইসঙ্গে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থানসহ সবধরনের সুবিধা উন্নততরভাবে ওই সমস্ত স্থানে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে অবশ্যই এসব মানুষগুলোর সিংহভাগ নিজ নিজ কেন্দ্র বা মফস্বল শহরে কাজের সুযোগ পাবে।”- যোগ করেন তিনি।

এই কথারই যেন প্রতিধ্বনিত হল রাজধানীর গাবতলী থেকে বাড়ির পথে রওনা হওয়া সাতক্ষীরা জেলার বাসিন্দা রুহুল কুদ্দুসের কণ্ঠে। তিনি বলেন, “স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে নিজের কর্মের সুবাদে আমি ঢাকাতেই থাকি। বাবা, মাসহ পরিবারের অন্যান্যরা গ্রামেই থাকেন। একটি সফটওয়ার কোম্পানীতে চাকরি করে আমি ৬০ হাজার টাকা বেতন পাই। যার অর্ধেক বেতনের একটি চাকরি নিজের এলাকায় পেলে আমি সেখানেই চলে যেতাম”।

এর কারণ উল্লেখ করে বলেন, নিজের পুকুরে মাছ, বাগানে টাটকা সবজি সবই আছে। কিন্তু বাচ্চাদের সেসব খাওয়াতে পারেন না। তারা খাচ্ছে ঢাকার বাজারে পাওয়া ভেজাল মেশানো খাবার।
তবে নিজ এলাকায় কর্মসংস্থানের পাশাপাশি তিনি বাচ্চাদের উন্নতমানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা চান।


চাই যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নতি

ঢাকার নিকটবর্তি গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার বাসিন্দা আল আমিন বলেন, “পরিবহনের সুব্যবস্থা থাকলে নিজের গ্রাম থেকেই আমি ঢাকায় আমার কর্মস্থলে আসা যাওয়া করতে পারতাম। কিন্তু অতিরিক্ত জ্যাম, পরিবহন সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকি। আমার কাছে আনন্দ মানে নিজের গ্রাম। তাই ঈদ উপযাপন করতে সেখানেই ফিরছি।”

এই যাতায়াত ব্যবস্থা সম্পর্কে ইকবাল হাবিব বলেন, “যোগাযোগের জন্য হাইস্পিড মোবিলিটি করিডোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সেক্ষেত্রে কোন একটি নির্দিষ্ট ‘মোডালিটির’ উপর ভিত্তি করে চিন্তা করা উচিত নয়। নদীপথ, রেলপথ এবং সড়ক পথগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করতে হবে। একটিকে বাঁচাতে অন্যটিকে মেরে ফেলা যাবে না।

বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, ঢাকা শহরের মানুষ বাড়ার অন্যতম একটি কারণ গার্মেন্টস। এই শিল্পকে বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে বিরাট একটি সংখ্যা ঢাকা ছাড়বে বলে মনে করেন তারা।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, শহরে অতিরিক্ত জনসংখ্যা বাড়ায় মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। মানুষে মানুষে সহমর্মিতা কমে যাচ্ছে। একই স্থানে অনেক মানুষ গাদাগাদি করে থাকার ফলে মানসিক দৈন্যতারও শিকার হচ্ছে। তাই শহরের মানুষগুলোকে যদি তাদের নিজ নিজ স্থানে ফেরত পাঠানো যায় তাহলে সমাজে জনসংখ্যার সুষম বণ্টণ হবে। কিন্তু তার জন্য সম্পদের সুষম বণ্টনও দরকার।


কেনো অবাসযোগ্য হয়ে উঠেছে ঢাকা

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বেনারকে বলেন, “সম্পদ, আদালত, নেতৃত্ব প্রভৃতি বিকেন্দ্রীকরণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানসিকতা আর সাহসের প্রয়োজন। না হলে আমাদের সমাজের এই চিরচারিত সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়”।

তার মতে, ঢাকা শহর ধীরে ধীরে এই বিরাট জনগোষ্ঠীর ভার নেওয়ার সক্ষমতা হারাচ্ছে। ফলে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সামাজিক কাঠামো। সে দিকটা না ভেবে শুধু মাত্র ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রাখার জন্য রাজনৈতিক নেতারা সমগ্র উন্নয়ন ঢাকা এবং চট্টগ্রামসহ কয়েকটি শহরকে নগর কেন্দ্রীক করে রেখেছে।

এদিকে সম্প্রতি দ্য ইকোনোমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট(ইআইইউ)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে বসবাসের অযোগ্য দশ শহরের মধ্যে প্রথম স্থানে দামেস্ক, এরপরই দ্বিতীয় স্থানে ঢাকা। অপরাধ, অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা, যানজট, স্বাস্থ্য সেবা, নাগরিকদের সহনশীলতার মাত্রা, শিক্ষা ও যানবাহন ব্যবস্থা, জনবসতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পরিবেশের ভারসাম্যের ওপর ভিত্তি করেই এই জরিপ করা হয়।

নেহাল করিম বলেন, “ইআইইউ কয়েক বছর ধরেই এ জরিপ কাজ পরিচালনা করছে এবং কেন শহরগুলো অবাসযোগ্য হচ্ছে তার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনও দিচ্ছে। ফলে এই প্রতিবেদন থেকে শহরগুলো চাইলে নিজেদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে। কিন্তু আগে দেখতে হবে সেই মানসিকতা আমাদের সরকারগুলোর আছে কিনা।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।