শুধুই ভূখণ্ড বিনিময়, স্থান বদল করতে আগ্রহীদের সংখ্যা খুবই কম
2015.07.21

বাংলাদেশ ও ভারতের দুই পারের মানুষ যে যার ভূমিতেই থেকে যাচ্ছেন। শুধু দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ভূখণ্ড দেওয়া-নেওয়া হবে, সেই প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ১১১টি ছিটমহলবাসীর বেশির ভাগই বাংলাদেশে থাকতে চান। আর ভারতের ভেতরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের কেউই দেশে আসতে চান না।
প্রায় ৬৮ বছর পর আগামী ১ আগস্ট থেকে শুরু হবে ঐতিহাসিক এই বিনিময়।গত জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় ছিটমহল বিনিময়ের চূড়ান্ত চুক্তি সই হয়।
সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় ভারতীয় যে ছিটমহলগুলোর মালিকানা পাচ্ছে বাংলাদেশ, সেখানকার মোট জনসংখ্যার মাত্র আড়াই শতাংশের মত ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। আর বাংলাদেশের যে ছিটমহলগুলোর মালিকানা ভারতের হাতে যাবে, সেখান থেকে আসবে আরও কম।
“বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় ১১১টি ছিটমহলের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার এবং ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশি ৫১টি ছিটমহলের জনসংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৯৭৯ জন ভারতে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশি ৫১টি ছিটমহলের কেউ বাংলাদেশে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেনি,” টেলিফোনে বেনারকে জানান কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন।
অবশ্য ঢাকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ছিটমহলের কোনো নাগরিক বাংলাদেশে আসার জন্য নাম নিবন্ধন করেছেন কি না, শেষ পর্যন্ত কজন আসবেন সে বিষয়ে তাঁরা এখনই কিছু বলবেন না।
“তবে যদি কেউ আসতে চান এবং তাঁর সহায়তার দরকার হয় তাহলে সরকার অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে,” বেনারকে জানান ছিটমহল বিনিময় প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনীম।
বাংলাদেশের ভেতরে চারটি জেলায় ভারতের ছিটমহল মোট ১১১ টি। এর মধ্যে লালমনিরহাটে ৫৯, পঞ্চগড়ে ৩৬, কুড়িগ্রামে ১২ এবং নীলফামারীতে চারটি। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী এই ছিটমহলগুলোতে জনসংখ্যা ছিল ৩৭ হাজার ৩৬৯ জন। গত ৬ থেকে ১৬ জুলাই পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৯ হাজার ৭২৫।
এই ছিটমহলগুলোয় এত দিন যারা বসবাস করতেন তাঁরা ছিলেন ভারতের নাগরিক। এখন এগুলো বাংলাদেশের মালিকানায় আসবে। কিন্তু এখানকার মাত্র ৯৭৯ জন ছাড়া সবাই এই মাটিতেই বসবাস করতে চাইছেন, বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে।
একইভাবে ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ছিটমহলের সংখ্যা ৫১ টি। ২০১১ সালের জনগণনায় সেখানকার মোট জনসংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ২১৫ জন। এখন তা প্রায় দুই হাজার বেড়েছে বলে বেসরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে। সেখানে বসবাসকারীরা এত দিন বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন। কিন্তু ভূখণ্ড বিনিময়ের পর সেখান থেকে কতজন বাংলাদেশে আসবেন তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়।
স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, যে ৯৭৯ জন ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁদের মধ্যে ধর্মীয় পরিচয়ের দিক দিয়ে হিন্দু-মুসলমান উভয়ই আছেন। কুড়িগ্রাম থেকে যে ৩১৭ জন যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁদের মধ্যে ১৫৯ জন মুসলমান।
এদের পরিবারের সক্ষম ব্যক্তিরা বহুদিন থেকে দিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে কাজ করে উপার্জন করছেন। অনেকে সেখানে বাড়িঘরও করেছেন। তাঁদের পক্ষে সে সব ছেড়ে আসা অনেকটাই অনিশ্চিত গন্তব্যে পাড়ি দেওয়ার মত।
ভারতে যাওয়ার জন্য নাম নিবন্ধন করেছে বাবুল চন্দ্র। পেশায় কৃষক। টেলিফোনে বেনারকে তিনি জানান,“ আমি ভারতে চলে যাব। সেখানে আত্মীয়স্বজন আছে। বড় দেশ কাজ করে খেতে পারব।”
অন্যদিকে, অনেকে যারা বাংলাদেশে থেকে যেতে চান তারা এখানেই আয়-উন্নতি ও সুযোগ-সুবিধার আশায় থেকে যাচ্ছেন।
“বাহে ৬৮ বছর থাকি আশায় আশায় আছি কুনদিন বাংলাদেশ হয়। আজ হামরা স্বাধীন। রাস্তা হাসপাতাল, সড়ক হইবে। ছাওয়ালগুলার জন্য স্কুল হইবে। খুব ভালো নাগছে, স্বাধীনতার স্বাদ কাক কয় এবার বুঝবার পারছি,” টেলিফোনে বেনারকে জানান কুড়িগ্রাম দাশিয়ার ছড়া ছিটমহলের বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক।
৮ম শ্রেণির ছাত্র মামুন হোসেন বেনারকে জানায়, “ আগোত হামরা ছিটের মানুষ ছিলাম। স্কুলোত গেইলে কয় ছিটের মানুষ। অখন এখানে স্কুল হইবে। তাই আনন্দ।”
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে এই সমস্যা সমাধানের কথা ছিল। কিন্তু তাও এত দিন কার্যকর হয়নি মূলত রাজনৈতিক কারণে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ১৯৭২ সালেই ছিটমহল বিনিময়ের বিষয়টি অনুমোদন করে। কিন্তু ভারতীয় পার্লামেন্ট তা (ল্যান্ড বাউন্ডারি এগ্রিমেন্ট) অনুমোদন করে এ বছর।