মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.11.16
BD-freedom মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরির বয়সসীমা ৬৫ তে উন্নীত করতে সরকারের প্রতি নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট।
বেনার নিউজ

মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরির বয়সসীমা ৬৫ তে উন্নীত করার প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদে উপস্থাপন করতে সরকারের প্রতি নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট। এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়সসীমা ৬৫ বছর বা যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সরকারি চাকুরির বয়সসীমা ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৬৫ বছর করার কথা বলে ২০০৬ সালে ওই প্রস্তাব রাখে সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়।

বিজয় দিবসের প্রাক্কালে সুপ্রিম কোর্টের এমন রায়কে স্বাগত জানিয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা।

তবে বিভিন্ন সরকার নানা ধরনের সুবিধা দিয়ে আসলেও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরাট একটি অংশ আজও সুবিধা বঞ্চিত অবস্থায় রয়ে গেছে।  আবার প্রদেয় সুবিধার ভাগীদার হতে অনেকেই জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। এমনকি  উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারাও সুবিধা পেতে মুক্তিযোদ্ধার ভূয়া সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে।

এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের (২০০৯-১৪) সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়স ৫৭ থেকে ৫৯ বছর করা হয়। তখন সরকারের অন্য কর্মকর্তাদের অবসরের বয়সসীমা ছিল ৫৭ বছর, অবশ্য পরে ৫৯ বছর করা হয়।

এ প্রেক্ষাপটে ২০১২ সালে একজন মুক্তিযোদ্ধা হাইকোর্টে বিষয়টি নিয়ে রিট করেন। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়সসীমা এক বছর বাড়ানো হয়। সে অনুসারে বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর।

এর মধ্যে ২০০৬ সালে নেয়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নেয়া প্রস্তাব প্রতিপালন না হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা জামাল উদ্দিন শিকদার ২০১৩ সালে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। রিটটি আমলে নিয়ে হাইকোর্ট রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ওই প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে উপস্থাপন করতে সরকারের প্রতি নির্দেশ দেয়। কিন্তু সরকার এর বিরুদ্ধে আপিল করলে ১৬ নভেম্বর আপিল বিভাগ তাদের আবেদন খারিজ করে।

এদিকে সোমবার আপিল বিভাগের রায়ের পর মুক্তিযোদ্ধা জামাল শিকদার বলেন, “অবশেষে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের প্রস্তাবটি মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে ওঠার দুয়ার খুললো। এবার আশা করি বিষয়টি বৈঠকে ওঠার পর আমাদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ার পক্ষেই সরকারের সিদ্ধান্ত আসতে পারে।”

আর রিট আবেদনের পক্ষের আইনজীবী আজহার উল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, “আদালত বলেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ৬৫ বা যে কোনো সিদ্ধান্ত সরকার নিতে পারে।”


সরকারের সুবিধা বঞ্চিত অনেক মুক্তিযোদ্ধা

মাসিক সম্মানী ভাতা, সন্তানদের চাকুরিতে বর্ধিত বয়সসীমা রাখাসহ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে সরকার। এমনকি  সকল বয়সী মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ১০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে, যা ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ভোগ করবেন তারা।

তবে স্বাধীনতার চার দশক পরেও এখনো দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াইকারী অনেক যোদ্ধারই ‘মুক্তিযোদ্ধা’ তালিকায় নাম ওঠেনি। এই কারণে তারা সরকার ঘোষিত বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি অনেকে দিনমজুর, ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমেও জীবিকা নির্বাহ করছেন।

এ বিষয়ে আজিজুর রহমান নামের সরকারি চাকুরিজীবী একজন মুক্তিযোদ্ধা বেনারকে বলেন, “আগামী মাসেই আমি সরকারি নিয়মে অবসরে যাচ্ছি। আমি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দেওয়া বর্ধিত বয়স সুবিধা নিতে পারছি না। কারণ, আমি মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহ করতে পারিনি”।

তবে তিনি বলেন, চেষ্টা করিনি এমনটি নয়। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন ছিল যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, সে সরকারের লোকদের প্রভাব অথবা অর্থ। কোনটিই না থাকায় আমি নিয়মানুযায়ী সনদ দাখিল করতে পারিনি। অথচ দেশের জন্য যারা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, আমি তাদেরই একজন। স্বাধীনতা নিয়েই তবে ফিরেছিলাম।

তিনি অভিযোগ করেন, দেশে এমন অনেকই আছেন যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও শুধু এক খণ্ড কাগজের অভাবে সরকারের সুবিধা নিতে পারছেন না। সরকারের উচিত কাগজ দেখে নয়, অভিজ্ঞতা বিচার করে মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করা।


সুবিধা নিতে ভূয়া সনদের আশ্রয়

একদিকে যেমন ‘প্রকৃত’ মুক্তিযোদ্ধারা সনদের অভাবে ‘সরকারি সুবিধা’ বঞ্চিত হচ্ছেন অন্যদিকে এই সুবিধা নিতে ভূয়া সনদের আশ্রয়ও নিচ্ছেন অনেকে।

২০১৪ সালে এমন চার সচিব ও এক যুগ্ম-সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেট বাতিল করেছে সরকার। সনদ বাতিল হওয়া পাঁচ কর্মকর্তা হলেন- স্বাস্থ্য সচিব নিয়াজ উদ্দিন মিয়া, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সচিব এ কে এম আমির হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান (বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় বেসরকারিকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান), মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী (বর্তমানে ওএসডি) এবং একই মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (ওএসডি) আবুল কাসেম তালুকদার।

দুবছর বেশি চাকরির করার সুযোগ ও অন্যান্য সুবিধার আশায় তারা ‘অবৈধ প্রক্রিয়ায়’ মুক্তিযোদ্ধার সনদ সংগ্রহ করেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের এক তদন্তে বেরিয়ে আসে। মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করে দুদক। সে সুপারিশ অনুযায়ী তাদের মুক্তিযোদ্ধার সনদ ও গেজেট বাতিল করে আদেশ জারি করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত আরেক মুক্তিযোদ্ধা জিয়াদ আলী বেনারকে বলেন, “দেশে হতদরিদ্র অবস্থায় দিনাতিপাত করা মুক্তিযোদ্ধাদের খবর পাওয়া যায়। তারা সরকারের বিশেষ কোন সুবিধা পান না”।

তিনি আরো বলেন, অথচ সচিবের পর্যায়ের কর্মকর্তারা  ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে চাকুরিতে সুবিধা পান। যদিও তারা ধরা পড়ায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, তবু এটা দেশের জন্য বড় ‘কলঙ্ক’ বলা যায়। সকল মুক্তিযোদ্ধাকে তারা অপমান করেছে। সরকারকেও এসব বিষয়ে আরো সচেতন হতে হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।