বেড়েছে কাজের চাপ, বেড়েছে দ্রব্যমূল্য: ভুগছেন পোশাক শ্রমিকরা

জেসমিন পাপড়ি
2019.08.15
ঢাকা
মজুরি বৃদ্ধির সুফল পায়নি             পোশাক শ্রমিকেরা একটি কারখানায় পোশাক শ্রমিকদের কাজ করার দৃশ্য, ধামরাই, ঢাকা, এপ্রিল ১৯, ২০১৮।
ছবি: এপি

গত বছর ডিসেম্বরে মজুরি বাড়লেও এর সুফল পায়নি বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকেরা। কারণ একদিকে বেড়েছে দ্রব্যমূল্য, আরেকদিকে বাড়তি কাজ করিয়ে বর্ধিত মজুরি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন বেশিরভাগ কারখানা মালিক। এমনটাই বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা পোশাক শ্রমিক খাতের নেতৃবৃন্দ ।

শ্রমিক নেতাদের আরও অভিযোগ হচ্ছে, মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন চলার সময়ই কয়েকশ শ্রমিকের চাকরি গেছে, ধাপে ধাপে এখনো অনেককে বাদ দেওয়া হচ্ছে।

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাংগঠনিক সম্পাদক কে এম মিন্টু বেনারকে বলেন, “ঈদুল আজহার ছুটির আগেও বেশ কিছু কারখানায় প্রায় তিন-চারশ শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে। এদের অধিকাংশই বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিল।”

গত ঈদুল ফিতরের সময়ও একইভাবে ছাঁটাইয়ের কথা উল্লেখ করে ওই শ্রমিক নেতা বলেন, পোশাক কারখানা মালিকদের যুক্তি হচ্ছে, মজুরি বৃদ্ধির পর আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য আনতে শ্রমিকদের কাজের চাপ বেড়েছে এবং শ্রমিক কমানো হচ্ছে।

তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি মশিউল আলম বেনারকে বলেন, “ঈদের আগে শ্রমিক ছাঁটাই হওয়ার খবর আমরা জানি না। তবে ওভেন পণ্য (শার্ট, প্যান্ট) যেসব কারখানা তৈরি করে, বছরের এই সময়ে তাদের হাতে কাজ থাকে না। এ জন্য মালিকেরা আর্থিক চাপে থাকে।”

“শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের সব পাওনা পরিশোধ করে ছাঁটাই করা হলে সেখানে সরকারের করণীয় কিছু নেই,” বেনারকে বলেন শ্রম সচিব কে এম আলী আজম।

“কিন্তু পাওনা পরিশোধ না করে ছাঁটাই হলে সংশ্লিষ্ট মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এ বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ আসতে হবে,” বলেন শ্রম সচিব।

এদিকে বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আবদুস সালাম বেনারকে বলেন, “উৎপাদন খরচ কমাতে নতুন নতুন মেশিন বসাচ্ছেন মালিকেরা। এতে শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে এবং বাড়বে উৎপাদন ক্ষমতা। এটাই এখনকার বাস্তবতা।”

বেড়েছে কাজের চাপ

শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ, উৎপাদনের মাধ্যমে বর্ধিত বেতন পুষিয়ে নিতে শ্রমিকদের ওপর কাজের চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকেই কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।

শ্রমিক নেতা কে এম মিন্টু বলেন, “শ্রমিক কমিয়ে উৎপাদন ঠিক রাখতে দুই বা তিনজনের কাজ একজন শ্রমিককে দিয়ে করাচ্ছেন মালিকেরা। আগে ঘণ্টায় একশ পিস তৈরি করত যেসব শ্রমিক, তাদের ১২০ থেকে ১৩০ পিস গার্মেন্টস পণ্য তৈরি করতে বলা হচ্ছে।”

তাঁর মতে, “উৎপাদনের চাপ বেশি হওয়ায় শ্রমিকেরা একসময় বাধ্য হয়েই কাজ ছেড়ে দিচ্ছে। মালিকপক্ষ ছাঁটাই করলে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, তাই শ্রমিক স্বেচ্ছায় চলে গেলে মালিকের লাভ,” বলেন কে এম মিন্টু।

শ্রমিক নেতা মাহাবুবুর রহমান বলেন, শ্রমিকেরা ভোরে কারখানায় ঢোকে, রাতে বের হয়। দৈনিক ১২-১৩ ঘণ্টা কাজের পাশাপাশি ওভার টাইমের জন্য সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও কাজ করে তাঁরা।

তবে বিজিএমইএ’র প্রথম সহসভাপতি আবদুস সালাম বেনারকে বলেন, “শ্রমিকদের বেতন ৩০-৪০ শতাংশ বেড়েছে। সেই টাকা দিতে হলে উৎপাদন কিছুটা বাড়াতে হবে। এ জন্যই হয়তো অতিরিক্ত কাজ করানো হয়।”

তিনি বলেন “আমাদের দেশের তুলনায় ভিয়েতনামের একজন শ্রমিক ৪০ শতাংশ বেশি কাজ করে। আমাদের শ্রমিকদেরও এমন দক্ষতা অর্জন করতে হবে।”

শ্রম সচিব বলেন, “শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করাতে হলে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিতে হয়। শ্রমিকেরা স্বেচ্ছায় ওভারটাইমের জন্য এই অনুমতি নেয়।”

তবে বিলসের নির্বাহী পরিচালক জাফরুল হাসান বলেন, “কন্টিনিউয়াস ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেসের (যেমন স্টিল মিল বা বিদুৎ কেন্দ্র) ক্ষেত্রে সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত কাজ করানো যেতে পারে। রপ্তানি লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে আইনের এই বিধির সুবিধা নেওয়া বেআইনি।”

তাঁর মতে, “আমাদের দেশে শক্তিশালী ইন্সপেকশনের অভাবে পোশাক শিল্প কারখানার মালিকেরা এই সুবিধা নিচ্ছেন।”

বেতন বৃদ্ধির সুবিধা মেলেনি

জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি মেনে নিলেও এই মুহুর্তে মজুরি বৃদ্ধি করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন শ্রম সচিব কে এম আলী আজম। তিনি বলেন, সবকিছু পর্যালোচনা করে যখন মজুরি বোর্ড গঠন করা হবে, তখন বিষয়টা দেখা হবে।

মাহাবুবুর রহমান মনে করেন, এই মুহুর্তে শ্রমিকদের জন্য কিছু একটা করা জরুরি। বিভিন্ন বাহিনীসহ দেশের ২০ লাখ সরকারি কর্মচারী রেশন পাচ্ছে। অথচ যাদের ঘাম ও শ্রমে দেশের রপ্তানি আয় বাড়ছে তাদের রেশন দেওয়ার দাবি ১৪ বছর ধরে উপেক্ষা করা হচ্ছে।

শ্রম সচিব বলেন, আপাতত শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে সরকারের ভাবনা নেই। তবে তাদের ‘ইনজুরি ইনস্যুরেন্সের’ বিষয়ে আলোচনা চলছে।

সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, প্রথম গ্রেডের একজন কর্মী সব মিলিয়ে ১৮ হাজার ২৫৭ টাকা, দ্বিতীয় গ্রেডে ১৫ হাজার ৪১৬ টাকা, তৃতীয় গ্রেডে ৯ হাজার ৮৪৫ টাকা, চতুর্থ গ্রেডে ৯ হাজার ৩৪৭ টাকা, পঞ্চম গ্রেডে ৮ হাজার ৮৭৫ টাকা, ষষ্ঠ গ্রেডে ৮ হাজার ৪২০ টাকা এবং সপ্তম গ্রেডে আট হাজার টাকা মজুরি পান।

তবে রপ্তানিতে রেকর্ড

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলার, যা গত অর্থ বছরের চেয়ে ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। গত ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে পোশাক রপ্তানিতে আয় হয়েছিল ৩ হাজার ৬১ কোটি ডলার।

এ ছাড়া পোশাক রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধির ফলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।

বিজিএমইএ’র সহসভাপতি মশিউল আলম বলেন, “কিছু কিছু গার্মেন্টস উচ্চদামের গার্মেন্টস পণ্য বানানোর চেষ্টা করছে। যেমন কোট, জ্যাকেট, স্পোর্টস আইটেম। এগুলো বেশ দামি।”

“এ ধরনের পণ্য তৈরি করার কারণে রপ্তানির ভলিউম বেশি হচ্ছে। আগে একশ পণ্য তৈরি করে যদি এক মিলিয়ন ডলার আসত, এখন এ ধরনের ৭০টি পণ্য তৈরি করে এক মিলিয়ন ডলার আসছে,” জানান তিনি।

মালিকদের অনেকেই প্রভাবশালী

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে গার্মেন্টস মালিকদের প্রভাব বেড়েছে। ফলে সরকার চাইলেও অনেক সময় শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক জাফরুল হাসান মনে করেন, গার্মেন্টস মালিকেরা এখন রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী। সরকারে এবং সমাজে তাদের প্রভাব বেশি হওয়ায় একটা অসম অবস্থা চলছে।

শ্রমিক নেতা মাহাবুবুর রহমান বলেন, “গার্মেন্টস মালিকদের অনেকেই এখন মন্ত্রী, সাংসদ। তারা নিজেদের সুবিধামতো আইন করতে পারেন। আমদানি, রপ্তানি, কর ছাড় পাওয়াসহ সরকারের নানা সুবিধাও তাঁরা পাচ্ছেন।”

“শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলার জন্য পেশাদার শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠার দরকার ছিল। কিন্তু মালিকপক্ষ সহজে ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেয় না। আর যেসব ইউনিয়ন আছে, অধিকাংশই মালিকদের সাথে আপস করে টিকে আছে,” জানান জাফরুল হাসান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।