হিজড়াদের ট্রাফিক পুলিশে নিয়োগ দেওয়া হবে, জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ দ্বিগুণ হবে
2015.05.28

সেবা খাতে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে সরকার। মন্ত্রিসভার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী-সংক্রান্ত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী অর্থবছর থেকে ট্রাফিক পুলিশ পদে তৃতীয় লিঙ্গ নিয়োগ দেবে সরকার।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বাংলাদেশে 'হিজড়া' হিসেবে পরিচিত পেলেও এ দেশে পৃথক ও স্বতন্ত্র লিঙ্গ হিসেবে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয় ২০১৩ সালে। সেসময় তাদের শিক্ষা ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়েও জোর দেওয়া হয়।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে জানা যায়, দেশে বসবাসরত হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর থেকে পাসপোর্টসহ সব ধরনের সরকারি নথিপত্রে ব্যক্তির লিঙ্গ পরিচয় হিসেবে ‘নারী’ ও ’পুরুষের’ পাশাপাশি ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ চিহ্নিত করার সুযোগ পেয়েছেন তারা।
হিজড়াদের নিয়ে আলোচনায় এখন ঘুরেফিরে আসে লাবণ্য হিজড়া ও নদী হিজড়ার সাহসিকতার কথা। গত ৩০ মার্চ সোমবার রাজধানীর বেগুনবাড়ি এলাকায় কয়েকজন দুর্বৃত্ত মুক্তমনা লেখক ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে হত্যা করে পালিয়ে যায়।
এ সময় তাদের পেছন থেকে জনতা ও পুলিশ ধাওয়া করলে পথে লাবণ্য হিজড়া ও তার সঙ্গী নদী হিজড়া জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির পক্ষ থেকে সম্প্রতি তাঁদের সম্মানিত করা হয়েছে।
অধিকারকর্মীরা মনে করছেন, বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় এ ধরনের ব্যক্তিদের ‘নিচু’ দৃষ্টিতে দেখা হয় বলে পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র সব জায়গায় তারা অধিকার বঞ্চিত হয়ে আসছেন। তাঁরা সরকারের এ ধরনের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন। তবে তারা বলছেন, সম্মানের সঙ্গে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজের সুযোগ করে না দিয়ে যদি কেবল এটা দেখানোর বিষয় হয়, তাহলে তা হবে দুঃখজনক।
“উদ্যোগটি আসলেই ভালো। কিন্তু এটা বাস্তবায়ন করতে হবে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে। তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা যেন কাজটাকে পেশার জায়গা থেকেই গ্রহণে সক্ষম হন, সেই সামাজিক পরিসর তৈরি করতে হবে,” বেনারকে জানান হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সালেহ আহমেদ।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করা মুক্তাশ্রি চাকমা বেনারকে বলেন, “খবরটা শুনে মিশ্র অনুভূতি হয়েছে। আমার প্রথম প্রশ্ন হলো, কেবল ট্রাফিক হিসেবে কেন তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে? যাদের অন্য যোগ্যতা আছে তাদের অন্য কাজে নিয়োগের দায়িত্ব কেন নিবে না সরকার?”
রাজধানীর রূপসী বাংলা হোটেলের সামনে প্রধান সড়কে ফুটওভারব্রিজের গোড়ায় বৃহস্পতিবার দেখা যায়, কয়েকজন হিজড়া গল্প করছেন। প্রচণ্ড গরমে তাঁদের কাহিল অবস্থা।
সরকারের নেওয়া উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে একজন হিজড়া বলেন, “শুনছি সরকার নাকি অনেক কিছু করছে। কিন্তু আমরা তো রাস্তায় আছি। মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলে খাচ্ছি,” জানান একজন হিজড়া।
“কোনো হিজড়া বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে, আশ্রয়ের অভাবে গাছ তলায় রাত্রি যাপন করবে এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আইনগত ও রাষ্ট্রীয়ভাবেই হিজড়াদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এখন যে বৈষম্য, তা তৈরি করেছে সমাজ,” বেনারকে জানান জাতীয় সংসদের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
গত ২৯ এপ্রিল বাংলা একাডেমিতে হিজড়াদের অধিকার বিষয়ক এক সেমিনারের মূল প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে হিজড়াদের যে স্বীকৃতি তার আইনি রূপ দেওয়া দরকার। রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন সেবা ও সুযোগে তাদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই প্রান্তিকতা ঘুচিয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করা, সমাজে তাদের স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো এবং তাদের জীবনমানে লক্ষণযোগ্য পরিবর্তন আনা সম্ভব।
রোবায়েত ফেরদৌস তাঁর প্রবন্ধে আরও বলেন, বাংলাদেশ কোনো মনোলিথিক রাষ্ট্র নয়; এটি একটি বহুজাতি, বহু ধর্ম, বহু ভাষা ও বহু লিঙ্গ ও বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ রাষ্ট্র; রাষ্ট্র পরিচালনায় ও সংবিধানের ধারায় এই বহুত্ববাদী নীতির প্রতিফলন থাকতে হবে। এই বহুত্ববাদই বিউটি অব ডেমোক্রেসি গণতন্ত্রের আসল সৌন্দর্য। কাজেই রাষ্ট্রকে কেবল ধর্মনিরপেক্ষ হলেই চলবে না, একে একই সঙ্গে জাতিনিরপেক্ষ, ভাষা নিরপেক্ষ, লিঙ্গনিরপেক্ষ ও যৌন নিরপেক্ষ হতে হবে।
“সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় চলতি ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ৩৫ জেলায় হিজড়াদের উন্নয়নমূলক কর্মসূচির সম্প্রসারিত করেছে এবং তাদের জন্য বরাদ্দ বাজেটকে আগামী অর্থবছরের জন্য চার কোটি থেকে দ্বিগুণ করার প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে, জানান সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রূপন কান্তি শীল। তিনি জানান, মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ পর্যন্ত ১৮ জন হিজড়াকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, ২৯টি জেলায় তাদের জন্য বার্ষিক প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা ভাতা দিচ্ছে সরকার। এর মধ্যে ৫০ বছরের বেশি বয়সী হিজড়ারা পাচ্ছেন মাসিক ৪০০ টাকা হারে। আর স্কুলগামী হিজড়ারা পাচ্ছে চারটি ক্যাটাগরিতে তিন শ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত।
“দয়া-দাক্ষিণ্য একজন নাগরিকের চাহিদা হতে পারে না। প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, বেনারকে জানান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান।