স্কুল ছাত্রীকে মারপিটের ভিডিও দেখে বখাটেকে পুলিশে দিলো জনতা
2015.09.04

বখাটের খপ্পরে পড়া কিংবা ইভ টিজিংয়ের শিকার হওয়া বাংলাদেশের নারীদের জন্য নতুন কোন খবর নয়। শিক্ষিকা, শিক্ষার্থী এমনকি আক্রান্ত কিশোরীর মাকেও প্রাণ দিতে হয়েছে এমন ঘটনায়। তবে ইভটিজিং বা বখাটেপনার বিরুদ্ধে সমাজে সচেতনতা বেড়েছে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই এসব অপরাধীদের ধরিয়ে দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। আর এসব সচেতনতামূলক কাজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশেষ করে ফেসবুকের ভূমিকা গুরত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বাংলাদেশে।
বখাটেকে পুলিশে দিয়েছে জনতা
সিলেটের হবিগঞ্জে ঘটেছে এমনই একটি ঘটনা। যেখানে অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীকে প্রকাশ্যে রাস্তায় মারপিট করার ভিডিও ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে, আলোচিত সেই রুহুলকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে জনতা।
শুক্রবার দুপুর ১টায় হবিগঞ্জ শহরতলির রিচি গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যসহ স্থানীয়রা তাকে নিয়ে সদর মডেল থানায় আসেন। এ সময় পুলিশ রুহুলকে গ্রেপ্তার করে।
তবে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজিম উদ্দিন জানান, রুহলের বিরুদ্ধে স্কুলছাত্রীর বাবা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা করেছেন। রিচি গ্রামের লোকজন আজ রুহুলকে আটক করে পুলিশে খবর দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে রুহুলকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসে।
স্থানীয়রা জানান, হবিগঞ্জ শহরের রাজনগর এলাকার রুহুল আমিন (১৫)কিছুদিন আগে প্রেমের প্রস্তাব দিলে মেয়েটি (১৪) তা প্রত্যাখ্যান করে। এতে সাড়া না পেয়ে হবিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের (জুনিয়র স্কুল) নবম শ্রেণির ছাত্র রুহুল মেয়েটিকে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার পথে উত্ত্যক্ত করত।
গ্রেপ্তারের পর হবিগঞ্জ থানাহাজতে রুহুল আমিন দাবি করেন, উত্ত্যক্ত করার ঘটনায় ওই ছাত্রীর এক আত্মীয় তাকে অন্য ছাত্রছাত্রীর সামনে মারধর করেছে। এ কারণে সে ক্ষুব্ধ হয়ে ওই ছাত্রীকে মারধর করেছে। তবে ভিডিও করার কোনো ইচ্ছা তার ছিল না। কে ভিডিও করছে সে জানে না।
যে ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে
প্রকাশ্যে ওই স্কুলছাত্রীকে মারধরের ভিডিওতে দেখা যায়, স্কুলের পোশাক পরা কয়েকজন ছাত্রী হবিগঞ্জ শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎ রুহুল ওই ছাত্রীর বাহুতে হাত দিয়ে তার পথ রোধ করে দাঁড়ায়। এর পর ছাত্রীকে গালাগাল করতে করতে তার গালে বেশ কয়েকটি চড় মারে। ভিডিওচিত্রের শেষের দিকে দেখা যায়, মেয়েটিকে মারধরের হুমকি দিতে দিতে চলে যাচ্ছে রুহুল।
স্থানীয়দের মারফত জানা যায়, এ সময় রুহুলের এক বন্ধু মোবাইল ফোনে এ দৃশ্য ধারণ করে। এরপর গত ১ সেপ্টেম্বর বিকেলে সে ফেসবুকে এ ভিডিওচিত্র আপলোড করে। এরপরই দেশজুড়ে তা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ছেলেটিকে আটক করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়।
‘পরিবারের কাছে নালিশ দিয়েও লাভ হয়নি’
দীর্ঘদিন ধরেই রুহুল মেয়েটিকে উত্যক্ত করে আসছিল। অতিষ্ঠ মেয়েটির পরিবার রুহুলের পরিবারের কাছেও নালিশ নিয়ে যায়। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি।
উত্ত্যক্তের শিকার মেয়েটির বাবা বলেন, “কয়েকবার রুহুল আমিনের পরিবারের কাছে নালিশ দিয়েছি আমরা। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি।”
বাড়ছে সামাজিক সচেতনতা
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিলেটের এ ঘটনা প্রমাণ করে, নারীর অধিকার এবং সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ছে। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার জন্য তারা পুলিশের অপেক্ষাও করছে না। এটা যে কোন সমাজের জন্য খুবই ইতিবাচক দিক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বেনারকে বলেন, “সিলেটের মানুষ অপরাধীকে ধরিয়ে দিয়ে একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করল। অর্থাৎ মানুষ সচেতন হচ্ছে। তাই যখন সাধারণ জনগন এক হয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়বে তখন জনতার শক্তিই জয়ী হবে। আর নারীরা সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখবে। এ ধরনের ঘটনা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। যাতে অন্যান্য এলাকার মানুষও অপরাধীদের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে।”
তিনি বলেন, জনগণ সচেতন হলে পুলিশও একটি সময় নিস্ক্রিয় থাকতে পারবে না। তবে আগের চেয়ে এসব ঘটনায় পুলিশ দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। কোন অপরাধই পুলিশের একার পক্ষে দমন সম্ভব নয়। একারণে সকলে মিলে সব ধরনের অপরাধকে ‘না’ বলতে হবে।
সক্রিয় হয়ে উঠছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
কিছুদিন আগে এমনই একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর আটক হয়েছিল শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যাকারীরা। এমনকি বিদেশে পালিয়ে গিয়েও রেহাই মেলেনি অন্যতম আসামি কামরুল ইসলামের। সংশ্লিষ্টরা বলছে, ফেসবুক ব্যবহার শুধু সময় নষ্ট করে না। এ ধরনের সামাজিক দায়িত্ববোধ বাড়ানোর মত কাজও করে। ভিডিও দেখে অপরাধী ধরা পড়ার এসব ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে।
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাজীব মীর বেনারকে বলেন, “কিছুদিন আগেও বলা হত, ফেসবুকে আসক্তি মানুষের প্রতি মানুষের আন্তরিকতাকে কমিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আজ সে কথা সত্যি নয়। ফেসবুক আজ একটি চেতনাবোধ তৈরির জায়গা হয়ে উঠেছে। সামাজিক অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষমতা তৈরি করছে এই যোগাযোগ মাধ্যম”।
তিনি তরুণ সমাজের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, “ফেসবুক যখন সমাজের এত বড় একটি শক্তি, তখন তাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। সামাজিক প্রতিরোধ বিষয়ক লেখা, ভিডিও বা ছবির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। তবেই সমাজে অগ্রগতির ধারা বজায় রাখা সম্ভব।”