মৃত্যুপথযাত্রীদের সেবা নিশ্চিতে পিছনের সারিতে বাংলাদেশ

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.10.07
BD-health দূরারোগ্য ব্যাধিতে যারা মৃত্যুপথযাত্রী তাদের সেবাদানের ব্যবস্থা সবচেয়ে কম বাংলাদেশে। অক্টোবর,২০১৫
বেনার নিউজ

মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের সেবা (প্যালিয়েটিভ কেয়ার) নিশ্চিতের দিক থেকে বিশ্বে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। হাসপাতাল ও সেবা-সদনে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষরা কতটুকু সেবা পান;  তার ওপর পরিচালিত এক বিশ্ব সমীক্ষায় এ চিত্র উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন,  পারিবারিক নির্ভরশীলতার কারণে বাংলাদেশে এখনো জীবনের শেষ সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক সেবার ব্যবস্থাটি সেভাবে গড়ে ওঠেনি।  

মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এর ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ‘কোয়ালিটি অব ডেথ ইনডেক্স’  শিরোনামের জরিপটির ফলাফল প্রকাশ করে। যেখানে দেখা যায় বিশ্বের ৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৯তম। শুধুমাত্র ইরান বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে।

ভাল হওয়ার নয় এমন কঠিন শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত এবং নিশ্চিত মৃত্যুর সম্মুখীন মানুষের কষ্টের মাত্রা হ্রাস করার প্রক্রিয়াকেই প্যালিয়েটিভ কেয়ার বলে।

সংবাদ সংস্থা বিবিসি জানিয়েছে হাসপাতাল ও সেবাকেন্দ্রে প্রশমনসেবা পাওয়ার সুযোগ, সেবার মান, সেবাদানকারীদের দক্ষতা এবং সেবা গ্রহণের সক্ষমতা- এই সূচকগুলোর ভিত্তিতে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে।


বাংলাদেশের চিত্র

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেই জীবনের শেষ সময়ের সেবা পেতে পছন্দ করেন। পরিবারের কাছে থেকেই তারা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান। তাছাড়া জীবনের ওই বিশেষ মূহূর্তে প্রাতিষ্ঠানিক সেবা পাওয়ার ধারণাটিও এদেশে এখনো নতুন।

তবে সম্প্রতি এই সেবার বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালসহ সরকারি কয়েকটি হাসপাতালে এ ধরণের সেবা ইউনিট আছে এবং হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তবে সেগুলোর সবই ঢাকাকেন্দ্রিক এবং সংখ্যাও অত্যন্ত কম।

শহিদুল ইসলাম নামে খুলনার একজন নাগরিক বেনারকে বলেন, “আমার মা সারাজীবন অনেক কষ্ট করে আমাকে লালন পালন করেছেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এখন তিনি মৃত্যুর দিন গুনছেন। ডাক্তাররা সকল আশা ছেড়েছেন। এখন আমি এবং আমার পরিবার তার সার্বক্ষণিক যত্ন নিচ্ছি। কিন্তু মাঝে মাঝে অসহ্য যন্ত্রণায় তিনি ছটফট করেন। তখন খুব অসহায় লাগে। তার সে যন্ত্রণা কমানোর চিকিৎসা বাড়ানোটা মন্দ নয়। তবে আমার মা আমার কাছেই শেষ নিঃশ্বাস ছাড়তে চান”।

শুধু বয়স্ক মানুষই নন, অনেক সময় শিশুদের ক্ষেত্রেও হাল ছেড়ে দেন ডাক্তাররা। তখন বাবা মা সন্তানের কষ্ট দেখে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়েন।

মেহেদি হাসান নামে ময়মনসিংহের একজন বাসিন্দা বেনারকে বলেন,  “ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত আমার ছোট ভাইকে ডাক্তাররা ‘আর কোন আশা নেই’  বলে বাড়িতে পাঠিয়েছিল। বাড়িতে কাটানো তার কষ্টকর শেষ দিনগুলোর কথা আজো ভুলতে পারেনি আমার পরিবার। মৃত্যুপথযাত্রী আমার ভাইকে যদি প্যালিয়েটিভ সেবা দেয়া যেত, তাহলে সত্যি ভাল হত!”


‘রোগীর জন্য কিছুই করার নেই’ কথাটা ঠিক নয়

সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ারের অধ্যাপক ড. নিজাম উদ্দীন বেনারকে বলেন,  “কোন রোগীর জন্য আর ‘কিছুই করার নেই’  একটি ভুল ও পলায়নপর মনোবৃত্তি। মানবিক দায়িত্ব হিসেবে কিছু না কিছু অবশ্যই করার থাকে। মৃত্যুপথযাত্রীর বেঁচে থাকার শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত চিকিৎসা বা সমাজসেবা ব্যবস্থায় পরিচর্যা করার মাধ্যমে মৃত্যু যন্ত্রণা কিছুটা হলেও কমানো যায়। সে চিন্তা থেকেই ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত বিএসএমএমইউ’র সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ার ইউনিট কাজ করে যাচ্ছে।

‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’  ধারনাটি এখনও এদেশে নতুন। প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র শতকরা এক থেকে দুই ভাগ মানুষের জন্য সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু ধীরে এর চাহিদা বাড়ছে। এজন্য সরকার এবং বিত্তশালীদের এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। এটি অবশ্যই একটি মানবিক ইস্যু।  

তবে এ সেবা দেয়ার জন্য প্রশিক্ষিত চিকিৎসক এবং নার্সেরও অভাব রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন,  এই সেবায় মূলত মৃত্যুপথযাত্রীর শারীরিক কষ্ট কমানোর পাশাপশি মানসিক সেবার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। আর সেভাবেই চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষিত করা প্রয়োজন।


সম্পদশালী দেশগুলোই এগিয়ে

জরিপে দেখা যায়, জীবনের শেষ মুহুর্তে প্রাতিষ্ঠানিক সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের সম্পদশালী দেশগুলোই এগিয়ে। মোট ১০০ পয়েন্টের মধ্যে ৯৩ দশমিক ৯ পয়েন্ট  নিয়ে তালিকায় প্রথম অবস্থানে আছে যুক্তরাজ্য। এরপর ৯১ দশমিক ৬ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে অস্ট্রেলিয়া আর ৮৭ দশমিক ৬ পয়েন্ট নিয়ে নিউজিল্যান্ড রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। এরপরে আছে আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম, তাইওয়ান, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্, ফ্রান্স, কানাডা, সিঙ্গাপুর, নরওয়ে, জাপান, সুইজারর‌্যান্ডের মত দেশ। এ সমীক্ষায় বাংলাদেশের পয়েন্ট ১৪ দশমিক ১। যেখানে গৃহযুদ্ধ কবলিত ইরাকের পয়েন্ট ১২ দশমিক ৫। আর ১৫ দশমিক ৩ পয়েন্ট নিয়ে নিচের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে আছে ফিলিপাইন।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা শ্রীলঙ্কা ২৭.১ পযেন্ট নিয়ে তালিকার ৬৫ নম্বর অবস্থানে রয়েছে। ১৭.১ পয়েন্ট মিয়ানমারের অবস্থান ৭৬ নম্বরে রয়েছে। তবে সমীক্ষায় আসেনি পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপের পরিস্থিতি।


বাড়ছে মৃত্যুর সময়কাল

ওই সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকায় প্রশমনসেবার গুরুত্ব দিনে দিনে বাড়ছে। কারণ অনেক দেশে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মতো রোগ বাড়ছে। এতে করে মৃত্যুর আগে ভোগান্তির সময়কাল বাড়ছে। একইসঙ্গে তাদের মৃত্যুকালীন সেবা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জও বেড়েছে।

এ বিষয়ে একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করে বিএসএমএমইউ’র অধ্যাপক ড. নিজাম উদ্দীন বলেন, ২০০৭ সালে গোটা বিশ্বে শুধু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। এদের মধ্যে ৭০ ভাগ মানুষকে মৃত্যুর আগে একটি দীর্ঘ সময় অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। অথচ অল্প প্রশিক্ষণেই সেবা ও সহযোগিতা দিয়ে এ ধরনের রোগীর ব্যথাহীন মৃত্যু নিশ্চিত করা সম্ভব।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।