সিরিয়ায় আইএস-এ যোগদানকারী বাংলাদেশি বিমান হামলায় নিহত
2015.12.30
সিরিয়া ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আইএসবিরোধী সামরিক জোটের বিমান হামলায় মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের ১০ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে একজন বাংলাদেশির নামও রয়েছে। সাইফুল হক সুজন নামের ওই ব্যক্তি যুক্তরাজ্য থেকে পড়াশোনা করা এক কম্পিউটার প্রকৌশলী। খবর বিবিসি ও গার্ডিয়ানের।
‘বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের উৎস ছিলেন সুজন’
আইএস বিরোধী বাগদাদ ভিত্তিক ওই সামরিক জোটের শীর্ষ মুখপাত্র কর্নেল স্টিভ ওয়ারেন বলেন, গত ৭ ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ইরাক ও সিরিয়ায় বিমান হামলায় নিহত এই ১০ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে গত ১০ ডিসেম্বর আইএসের কথিত রাজধানী সিরিয়ার রাকা প্রদেশের কাছে বিমান হামলায় সাইফুলের মৃত্যু হয়।
তিনি জানান, নিহত সুজন বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করত। ইসলামিক স্টেটের হয়ে সে হ্যাকিং কর্মকাণ্ড, নজরদারি প্রতিরোধ প্রযুক্তি এবং অস্ত্র উন্নয়ন কাজেও নিয়োজিত ছিল। আইএস’র ওয়েবসাইটগুলোকেও মার্কিন বা বিশ্বের অন্যান্য হ্যাকারদের হাত থেকে বাঁচাতে তিনিই সক্রিয় ভূমিকা রাখতেন। তাই তার মৃত্যুতে আইএস বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের একটি উৎস হারাল।
তবে তাৎক্ষণিকভাবে সুজনের বিস্তারিত তথ্য জানাতে পারেননি এই মার্কিন সেনা কর্মকর্তা।
‘ব্রিটেনে অভিবাসন চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হন সুজন’
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যগুলো জানায়, সাইফুল হক ২০০৩ সালে শিক্ষা ভিসায় যুক্তরাজ্যে যান। পরে সেখানে অভিবাসনের জন্য আবেদন করলেও কয়েকদফা প্রত্যাখ্যাত হন।
এদিকে খবরটি প্রকাশের পর বুধবার একাধিক টুইট বার্তায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক টম ওয়াইক লিখেছেন, সাইফুল ১০ বছর যুক্তরাজ্যে ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ও এক ছেলে রয়েছে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি কার্ডিফে বসবাস করতেন। সর্বশেষ ওই বছর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তার ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করলে তিনি সিরিয়ায় চলে যান। সেখানে সাইফুল আবু খালিদ আল-বাঙালি নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি আইএসের আরেক ব্রিটিশ জঙ্গি জুনায়েদ হোসেনের সঙ্গে কাজ করতেন। জুনায়েদের মৃত্যুর পর সাইফুল এই জঙ্গিগোষ্ঠীর হ্যাকিং দলের হাল ধরেন।
টম ওয়াইক সাইফুলের বয়স ৩১ লিখলেও অন্য পশ্চিমা গণমাধ্যমে তার বয়স ৩৪ বছর বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্যারিস হামলায় সংযোগ ছিল দুজনের
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো আরো জানায়, বিমান হামলায় নিহত যে ১০ জন আইএস নেতার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্তত দুজনের সঙ্গে ১৩ নভেম্বরে প্যারিসে হামলাকারীদের যোগাযোগ ছিল বলে মার্কিন সামরিক জোটের মুখপাত্র স্টিভ ওয়ারেন জানিয়েছেন।
প্যারিসে ওই সন্ত্রাসী হামলায় ১৩০ জনের প্রাণহানি হয়। আইএস এ হামলার দায় স্বীকার করে।
স্টিভ ওয়ারেন বলেন, নিহত আইএস নেতাদের মধ্যে একজনের নাম শারাফে আল মুদান। তিনি সিরিয়াভিত্তিক একজন আইএস কমান্ডার ছিলেন, যার সঙ্গে প্যারিসের মূল হামলাকারী আবদেল হামিদ আবাউদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। মুদানের মৃত্যু হয় ২৪ ডিসেম্বরের এক বিমান হামলায়। তার দুই দিন পর ইরাকের মসুলে আরেক হামলায় নিহত হন আবদুল কাদের হাকিম নামে আরেক আইএস কমান্ডার। তাঁর সঙ্গেও প্যারিসের হামলাকারীদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল।
নিহত বাকি সাত আইএস নেতার মধ্যে তাশিন আল হাইয়ালি আইএসের বহির্বিশ্বে কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ২৭ ডিসেম্বর মসুলে নিহত হন। ১২ ডিসেম্বর ইরাকের তাল আফার এলাকায় নিহত হন আকরাম মোহাম্মদ সা’দ ফারিস ওরফে আকরাম আবু। তিনি আইএসের শিরশ্ছেদকারী দলের একজন কমান্ডার ছিলেন। ৯ ডিসেম্বর ইরাকের কিরকুক প্রদেশে আইএসের ডেপুটি আমির মিথাক নাজিম পার্শ্ববর্তী হাউয়িজাহ এলাকায় বিমান হামলায় নিহত হন।
একই দিন মসুলে নিহত হন সেখানে আইএসের অর্থবিষয়ক ডেপুটি আমির ইউনুস খালাশ ওরফে আবু জাওদাত। তার আগে ৮ ডিসেম্বর কিরকুকের কাছে নিহত হন আবু আনাস, যিনি হাতে তৈরি বোমার (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস-আইইডি) বিশেষজ্ঞ ছিলেন। এ ছাড়া ৭ ডিসেম্বর নিহত হন আইএসের আরও দুই নেতা। তাদের মধ্যে রাওয়ান্দ দিলশার আইএসের বহির্বিশ্বে কর্মকাণ্ডের নেতা ছিলেন। আর খলিল আহমেদ আলী আল-ওয়াইস ওরফে আবু ওয়াদাহ কিরকুক প্রদেশে আইএসের আমির ছিলেন। এঁরা নিহত হয়েছেন যথাক্রমে সিরিয়ার রাকা ও ইরাকের হাউয়িজাহ এলাকায়।
সুজনের পরিচয় অবগত নয় বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমুগলো ‘বাংলাদেশি জঙ্গি’ সাইফুল হক সুজনের নিহতের খবর প্রচার করলেও এ ধরনের কোন তথ্য অবগত নয় বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এ বিষয়ে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, সিরিয়াতে বাংলাদেশি নিহতের খবরটি আমাদের জানা নেই। তবে গণমাধ্যমে খবরটি আমরা শুনেছি। কিন্তু বিষয়টি এখনো ভেরিফাইড নয়। মিডিয়াতে তার কোন ঠিকানাও প্রকাশ করা হয়নি। আর মিডিয়াতে প্রকাশ ছাড়া তার বিষয়ে আমরা আর কোন তথ্য পাইনি। পরবর্তীতে তার ঠিকানা পাওয়া গেলে, তবেই আমরা যাচাই করে দেখব তিনি (সাইফুল হক সুজন) বাংলাদেশি নাগরিক কিনা।
সাইফুল হক সুজন ছাড়াও এর আগে কয়েকজন বাংলাদেশি তরুণ ও তরুণীর আইসিসে যোগ দেওয়ার খবর পাওয়া যায়। সর্বশেষ বাংলাদেশের ১২ সদস্যের একটি পরিবারের আইএসে যোগদানের খবরে সারা দুনিয়ায় তোলপাড় শুরু হয়। তবে এ পর্যন্ত যতজন বাংলাদেশির আইএসে যোগ দেওয়ার খবর এসেছে, তাদের বেশির ভাগই ব্রিটেনের নাগরিক।
পরিচয় সঙ্কটে আইএস শিবিরে ব্রিটিশ বাংলাদেশি মেয়েরা
আত্মপরিচয় সঙ্কটের কারণে ব্রিটিশ বাংলাদেশি মেয়েরা আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস-এ যোগ দিচ্ছে বলে মনে করেন ব্রিটিশ সংসদ সদস্যবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি টিউলিপ সিদ্দীক।
বাংলাদেশ সফরে এসে এক সংলাপ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে টিউলিপ সিদ্দীক বলেন, যারা বৃটেনে জন্ম নেন, সেখানে বড় হন; তারা অনেকেই ভালো বাংলা বলতে পারেন না। ব্রিটিশরাও তাদের ব্রিটিশ মনে করছে না, আবার বাংলা না বলতে পারায় বাংলাদেশিরাও তাদের আপন করছে না। তাই পরিচয় সঙ্কটে ভোগেন তারা। তখন নিজের একটি পরিচয় তৈরি করতে তারা আইএস-এ যোগ দিচ্ছেন; যা খুবই দুঃখের।
ওয়েস্ট মিনিস্টারের পথে পাওয়া অভিজ্ঞতাগুলো জানাতে বসে টিউলিপ বলেন, জঙ্গীবাদের জন্য ইসলাম দায়ী নয়। আমি মুসলমান হিসেবে গর্ব করি।