ফাঁসির জন্য অপেক্ষা কামারুজ্জামানের
2015.04.06

‘ডিসমিসড’ (খারিজ)।এই একটি শব্দের মাধ্যমে ৬ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচার-প্রক্রিয়া শেষ করেছে।
বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ আপিল বিভাগের চার বিচারপতি এই রায় ঘোষণার পর কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। গতকাল সোমবার পরিবারের ১১ সদস্য তাঁর সঙ্গে কারাগারে গিয়ে শেষ দেখা করেছেন।
“আমরা সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। শুধু একটি নির্দেশ পাওয়ার অপেক্ষা আছি,” বেনারকে জানান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী।
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চে গতকাল কামারুজ্জামানের পুনর্বিবেচনার আবেদনের শুনানি হয়। এই বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
“কামারুজ্জামানের পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। এখন মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেতে হলে তাঁকে একমাত্র রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে হবে। রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করলে তবেই মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পাবেন তিনি,” আদেশের পর সাংবাদিকদের জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার পর বুধ ও বৃহস্পতিবার হরতাল ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী। গণজাগরণ মঞ্চ ফাঁসি কার্যকর করার দাবিতে শাহবাগে দিনভর অবস্থান কর্মসূচী পালন ছাড়াও আনন্দ মিছিল করেছে এবং ফাঁসি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত শাহবাগে অবস্থান চালিয়ে যাবে।
একাত্তরে সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের দায়ে ২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানকে ফাঁসির আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে আসামিপক্ষ।
গত বছরের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে ফাঁসির ওই আদেশ বহাল রাখেন। এরপর গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। পরদিন ট্রাইব্যুনাল-২ মৃত্যু পরোয়ানায় সই করে কারাগারে পাঠালে সেখানে বন্দী কামারুজ্জামানকে তা পড়ে শোনানো হয়।
পরে ৫ মার্চ ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করে আসামিপক্ষ। গতকাল সেই আবেদন খারিজ করেন আপিল বিভাগ।
“কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার বিষয়টি এখন পুরোপুরি সরকারের হাতে। এ ক্ষেত্রে কারাবিধি কার্যকর হবে না,” রায়ের পর জানান মাহবুবে আলম।
কত দিনের মধ্যে কামারুজ্জামানকে প্রাণভিক্ষা চাইতে হবে-এমন প্রশ্নে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা বলেন, এ ক্ষেত্রে কোনো দিন নির্দিষ্ট নেই। যেকোনো সময় আনুষ্ঠানিকতা সেরে সরকার রায় বাস্তবায়ন করতে পারে।
“অন্যান্য মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে কারা আইনে ‘৭ দিনের আগে না, আবার ২১ দিনের পরে না’-এমন বিধান আছে। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার ক্ষেত্রে ওই আইন প্রযোজ্য হবে না,” বেনারকে জানান সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ।
শফিক আহমেদ বলেন, মামলার অভিযোগ স্বীকার করে কামারুজ্জামান যদি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চান, তাহলে তাঁর পাশাপাশি দলের অন্য নেতা ও সংগঠন হিসেবে জামায়াতের মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার বিষয়টি একেবারেই প্রতিষ্ঠিত হবে। সে ক্ষেত্রে তিনি কাদের মোল্লার মতো হয়তো রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন না বলে ধারণা এই আইনজীবির।
কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ হয়ে ফাঁসির আদেশ বহাল থাকায় আনন্দ মিছিল করেছে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা সংগঠন গণজাগরণ মঞ্চ।
“কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের সংবাদ শুনেই আমরা ঘরে ফিরব,” বেনারকে জানান মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।
রায় কার্যকরের দাবিতে সকাল থেকেই শাহবাগে অবস্থান নেন মঞ্চের কর্মী-সংগঠকেরা। এ সময় তাঁরা কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় বহালের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দেন। পাশাপাশি চলে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক কর্মসূচি।
আপিল বিভাগে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হয়ে ফাঁসির রায় বহালের ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী-সংগঠকেরা। এ সময় তাঁরা আনন্দ মিছিল বের করেন।
ইমরান বলেন, রায় কার্যকর হলে বাংলাদেশের জনগণ ন্যায় বিচার পাবে।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলায় জন্ম নেন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার প্রধান।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ২২ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে জামালপুরের আশেক-মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি। এই বাহিনী সে সময় ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইলে ব্যাপক মাত্রায় যুদ্ধাপরাধ ঘটায়।
স্বাধীনতার পরের বছর ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন কামারুজ্জামান। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে থেকে মাস্টার্স পাস করার পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমনের আমলে ১৯৭৮-৭৯ সালে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৯ সালের অক্টোবরে কামারুজ্জামান মূল দল জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন এবং ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর রুকনের দায়িত্ব পান।
১৯৮২-১৯৮৩ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বেও ছিলেন। একসময় জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য পদে থাকলেও যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে তাকে ও কাদের মোল্লাকে বহিষ্কার করা হয়।
১৯৯২ সাল থেকে তিনি দলে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মোহাম্মদ কামারুজ্জামান বৃহত্তর ময়মনসিংহে আলবদর বাহিনীকে সংগঠিত করেন বলে যে তথ্যপ্রমাণ প্রসিকিউশন উপস্থাপন করেছে- আসামির আইনজীবিরা তা খণ্ডাতে পারেননি।
প্রসিকিউশন অভিযোগে বলেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পর পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে বৃহত্তর ময়মনসিংহে যে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলা হয়, কামারুজ্জামান ছিলেন তার ‘চিফ অর্গানাইজার’।
এর পক্ষে প্রসিকিউটররা দৈনিক সংগ্রামের সেই সময়ের একটি প্রতিবেদনও উপস্থাপন করেন, যে পত্রিকাটি জামায়াতের মুখপত্র হিসাবে পরিচিত।
আর দল হিসাবে জামায়াতকেও যুদ্ধাপরাধে দায়ী করে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সেই সময়ে দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামীদের ‘সন্ত্রাসী ও গুপ্তচর’ আখ্যায়িত করে নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। আর এ কাজে তারা ব্যবহার করে নিজেদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত আলবদর এবং জামায়াতকর্মীদের নিয়ে গঠিত রাজাকার বাহিনীকে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, জামায়াতে ইসলামী এসব মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনায় মূল ভূমিকা রাখে। আর আল বদর বাহিনী কাজ করে খুনে বাহিনী (ডেথ স্কোয়াড) হিসাবে।
উল্লেখ্য, জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করা সংক্রান্ত একটি আইনের খসড়া আইন মন্ত্রণালয় থেকে ইতিমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে গেছে। যে কোনো দিন মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনটি অনুমোদন হতে পারে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।